ঢাকাতেই ঝুঁকিপূর্ণ ভবন পৌনে এক লাখ, দায় কার?

রাজধানী ঢাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা কত তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও প্রায় ৭০ হাজার ভবন ভূমিকম্প ঝুঁকিতে আছে বলে জানিয়েছে সরকার। ভূগর্ভস্থ নরম মাটি, বিল্ডিং কোড না মানা ও অপরিকল্পিত নগরায়ণসহ নানা কারণে ঝুঁকিপূর্ণ থাকা এসব ভবন চিহ্নিত করার নির্দেশ দেয়া হলেও অপসারণের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। ভবনগুলোতে এখনো বসবাস করছে লাখ লাখ মানুষ। এদের সরিয়ে নেয়ারও উদ্যোগ নেই কারো। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান দুই সিটি করপোরেশন এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কেউই এর দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে না। ভবন অপসারণের দায়িত্ব নিয়ে সংস্থা তিনটি একে অপরকে দোষারোপ করছে।

রাজউক প্রদত্ত ভূমি মন্ত্রণালয়ের এক হিসাবে রাজধানীতে ৭০ হাজারেরও বেশি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। আর সরকারের সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির (সিডিএমপি) এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে এর সংখ্যা ৭৮ হাজার। এর মধ্যে শুধু সরকারী ভবনই আছে প্রায় ৫ হাজার।

সিডিএমপির সর্বশেষ রিপোর্টে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার ভূতাত্ত্বিক অবস্থানের কারণে ভয়াবহ ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। এ এলাকায় ইরানের রাজধানী তেহরানের পর বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানতে পারে। শক্তিশালী কোনো ভূমিকম্প আঘাত হানলে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ধসে পড়ার আশঙ্কার কথাও উল্লেখ আছে ওই প্রতিবেদনে। আর এতে ঘনবসতির শহর রাজধানী ঢাকায় কি পরিমাণ প্রাণহানি ঘটতে পারে তা কল্পনা করা কঠিন কিছু নয়।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির জরিপ অনুযায়ী, রাত ২টায় ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরে ৮৮ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটতে পারে। আর যত মানুষ আহত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তাদের সবার চিকিৎসা দেয়ার প্রস্তুতিও তেমন নেই মহানগরীতে। এত ভয়াবহ আশঙ্কার পরেও কার্যত কাগজে কলমে কয়েকটি সিদ্ধান্ত ছাড়া তেমন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না সরকার।

সম্প্রতি রাজধানীতে ভূমিকম্পের পর বেশ কয়েকটি ভবন হেলে পড়েছে। এসব ভবনের ব্যাপারে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও তার প্রতিবেদন বাস্তবায়নে সংশয় রয়েছে।

ডিসিসি সূত্র জানায়, রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয় ২০০৮ সালে। ওই বছরে পুরান ঢাকার শাখারী বাজারে ভবন ধসে ১৭ জনের মৃত্যু হলে ঢাকা সিটি করপোরেশন ঝুঁকিপূর্ণ ভবন শনাক্ত করার উদ্যোগ নেয়। প্রথম অবস্থায় সিটি করপোরেশন সাড় ৫ হাজার ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হিসেবে চিহ্নিত করে। পরে কারিগরি সহায়তা ও অর্থের সঙ্কুলান না হওয়ায় জরিপ কাজ অব্যাহত রাখা যায়নি।

রাজধানীতে ৭০ হাজারেরও বেশি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ থাকলেও রাজধানীতে মাত্র ৩২১টি ভবন ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে রাজউক। ২০১৪ সালের ১৫ জুন জাতীয় সংসদে এমনটিই জানিয়েছিলেন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন।

রাজউক সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগরীর ৫৯০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ১২ লাখ ৫০ হাজার ভবন রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান শহরেই আছে ৩ লাখ ২৬ হাজার ভবন। আর হ্যারিটেজ বা ঐতিহ্যবাহী ভবন আছে ২২৯টি। এছাড়া মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ ৩২১টি। এর মধ্যে বিধিবিধান লঙ্ঘন করে নির্মিত ভবন আছে ৫ সহস্রাধিক।

রাজউকের ওই তালিকায় ৩২১টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের মধ্যে বেশিরভাগই পুরান ঢাকায় অবস্থিত। ওই এলাকার সূত্রাপুরে ১৪৬টি, কোতোয়ালিতে ১২৬টি ও লালবাগে ২৮টি ভবন রয়েছে। এ ছাড়া মোহাম্মদপুরে ৬টি, ডেমরায় ৩টি, মিরপুরে ৭টি, রমনায় ১টি, তেজগাঁওয়ে ১টি, মতিঝিলে ২টি ও ধানমণ্ডিতে ১টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন আছে।

এ ব্যাপারে রাজউকের পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক সদস্য প্রকৌশলী শেখ আব্দুল মান্নান বাংলামেইলকে বলেন, ‘রাজউকের আওতাভুক্ত এলাকায় ভবন নির্মাণে নকশার অনুমোদন ও অনুমোদিত ভবনগুলো নির্মাণ চলাকালে তা নিয়ন্ত্রণ করাই রাজউকের প্রধান কাজ। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন শনাক্ত করার দায়িত্ব রাজউকের না সিটি করপোরেশনের। আমরা অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো অপসারণের জন্য সিটি করপোরেশনকে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

জানা গেছে, কয়েক বছর আগে ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা রাজধানীর ২ হাজার ৯৯৪টি ভবন জরুরি ভিত্তিতে ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে মাত্র ৬টি ভবন ভাঙা শেষ হয়েছে।

এবিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসির) প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম বাংলামেইলকে বলেন, ‘২০০৪ সালে বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহায়তায় আমরা একটি কারিগরি টিম গঠন করে পুরো ঢাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করার কাজ শুরু করি। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে পুরো কাজ শেষ করতে পারিনি। সে সময় ৫ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে কাজ শেষ করে দিতে হয়েছে। এ সব ভবনের অধিকাংশ নকশা রাজউক অনুমোদন দিয়েছে।’

সিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আইন অনুযায়ী ভবনের অনুমোদন দেয় রাজউক। নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বও রাজউকে। রাজউক অনুমোদিত নকশায় নির্মিত ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হোক বা নকশার ব্যত্যয় ঘটুক সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব রাজউকের।

গত ২৫ এপ্রিল নেপালে ভূমিকম্পের ঘটনায় প্রায় ৭ হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এর সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করেছেন নেপাল প্রধানমন্ত্রী সুশিল কৈরালা। একই সময়ে বাংলাদেশেও ভূকম্পন অনুভূত হয়। ‘আফটার শক’ হিসেবে পরের দুই দিনও কেঁপে ওঠে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে প্রথম দিন চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এতে হেলে পড়েছে প্রায় ডজনখানেক বহুতল ভবন। ওই সময়ে বয়ে যাওয়া কয়েক দফা ভূমিকম্পের পর রাজধানীর ৭০ হাজার ঝুঁকিপূর্ণ ভবন বিশেষ রঙ দিয়ে চিহ্নিত করে তাতে ‘ঝুঁকিপূর্ণ ভবন’ সাইনবোর্ড ঝোলাতে বলেছে সরকার। এজন্য দুই সিটি করপোরেশন ও রাজউককে নির্দেশ দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্মসম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘ভালোভাবে সার্ভে করলে রাজধানীর ৮০ ভাগ ভবনই ঝুঁকিপূর্ণ হবে। কারণ, দু’বছর আগে বুয়েট রাজধানীর ধানমণ্ডি ও মোহাম্মদপুর এলাকায় একটি টেকনিক্যাল সার্ভে করেছিলো। সেখানে আমিও যুক্ত ছিলাম। এতে দেখা গেছে, ধানমণ্ডি এলাকার ৬৭ ভাগ ও মোহাম্মদপুর এলাকার ৭০ ভাগ ভবনই ৭ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল নয়। পুরান ঢাকাসহ অন্যান্য এলাকায় জরিপ করলে এর মাত্রা আরো অনেক বাড়বে।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ঝুঁকিপূর্ণ বহুতল ভবনগুলো একটু বড় ধরনের ভূমিকম্পের ধাক্কা সহ্য করতে পারবে না। তাই বড় ধরনের কোনো দুর্যোগ আসার আগেই এ বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি।

Scroll to Top