রাস্তার দু’ধার, চৌমাথা, উঁচু উঁচু হোর্ডিং সবই তো নরেন্দ্র মোদীর ছবিতে ছয়লাপ! বিস্ময় গাঢ়তর হবে যখন নজরে পড়বে, মোদীর নানা পোশাক ও ভঙ্গির পোস্টারের পাশেই হাস্যমুখে বিরাজমান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়!
এটা কি আসানসোল, না কলকাতা, নাকি…!
আজ্ঞে না, এটা ঢাকা! বাংলাদেশের রাজধানী!
স্থলসীমান্ত চুক্তি-সহ অন্তত ২০টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সামনে রেখে নরেন্দ্র মোদী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যৌথ সফরের মুখে এ ভাবেই আবেগে ভাসছে ঢাকা। যে আবেগের ঢেউয়ে ভেসে গিয়েছে বিএনপি বা জামাতের মতো দলগুলির তীব্র ভারত বিরোধিতার সুরও। এতটাই যে, রোববার মোদীর সঙ্গে বৈঠকেও বসবেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া।
যে বৈঠক নিয়ে রীতিমতো উৎসাহ দিল্লির অলিন্দেও।
এই সফরের মাহাত্ম্য বোধহয় এখানেই!
বিদেশি কোনও রাষ্ট্রনেতার পোস্টারে এ ভাবে শেষ কবে ছয়লাপ হয়েছে ঢাকা, তা চট করে মনে করতে পারছে না শহর। শুধু এটুকুই বলা যাচ্ছে, মোদীর দু’দিনের সফর ঘিরে স্থানীয় বাসিন্দা থেকে রাজনৈতিক শিবির, আমলা থেকে বিশেষজ্ঞ— সর্বস্তরে যে উথালপাতাল আবেগ দেখা যাচ্ছে, তা যথেষ্ট বিরল এক অভিজ্ঞতা। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে ইন্দিরা-মুজিব স্থলসীমান্ত চুক্তির দিনটিও স্মরণ করছে শহর। সেই স্মৃতিকে উস্কে দিতে সেই সাদা-কালো ছবির বড় কাটআউট লাগানো হয়েছে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে। অনেকেই বলছেন, আগামিকাল এক নতুন ইতিহাসের সূচনা হতে চলেছে ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে।
আবেগের ছোঁয়া লেগেছে দিল্লিতেও। সেখানে শুক্রবার সন্ধ্যায় সাংবাদিক বৈঠক করতে গিয়ে আবেগহীন কূটনীতিক হিসেবে পরিচিত বিদেশসচিব এস জয়শঙ্করও বলেছেন, ‘‘আমি সাধারণত কোনও সফরকে ঐতিহাসিক বলি না। কিন্তু এই সফরকে বলছি।’’ বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর জন্য যে একগুচ্ছ পদক্ষেপ দিল্লি করতে চলেছে, তার মধ্যে কয়েকটির কথা আজ ঘোষণা করেছেন তিনি। যার মধ্যে রয়েছে শিলিগুড়ি থেকে বাংলাদেশে নতুন একটি পাইপ লাইন প্রকল্প। যার মাধ্যমে ডিজেল আসবে এ দেশে। উদ্দেশ্য, প্রবল শক্তি সঙ্কটে ভোগা বাংলাদেশকে জ্বালানি সরবরাহ। বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের অভিযোগ, সে দেশের কোনও চ্যানেল ভারতে সম্প্রচার করার অনুমতি পায় না। এ বার সে ব্যাপারেও কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ করা হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন বিদেশসচিব।
শনিবার সকাল থেকে পরবর্তী ছত্রিশ ঘণ্টা রীতিমতো এক্সপ্রেস গতিতে চলবে মোদীর ঢাকা সফর। সাভারের জাতীয় শহিদ মেমোরিয়াল, বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল মিউজিয়াম, ঢাকেশ্বরী মন্দির, রামকৃষ্ণ মিশন, বঙ্গবন্ধু ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার, তেজগাঁওয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অফিস, বঙ্গভবনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ সব চলবে ঘড়ির কাঁটা ধরে। তবে সমস্ত অনুষ্ঠানের কেন্দ্রীয় স্থানে রাখা হচ্ছে ভারতের দুই কক্ষ থেকে পাশ হয়ে আসা স্থলসীমান্ত চুক্তির প্রোটোকল স্বাক্ষর অনুষ্ঠানটি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মিডিয়া উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরীর কথায়, ‘‘বাংলাদেশ যে বিষয়টি নিয়ে অভিভূত, তা হল ভারতের সংসদীয় কক্ষদ্বয়ের একটি ভোটও এই চুক্তির বিপক্ষে যায়নি। সমস্ত রাজনৈতিক দলমত নির্বিশেষে সমর্থন পাওয়া গিয়েছে। ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের পর এমন সার্বিক বাংলাদেশ-মুখী মানসিকতা কিন্তু আর দেখা যায়নি।’’
আওয়ামী লীগ শিবিরের দাবি, ভারতের এই সক্রিয়তার ফলেই বিএনপি-জামাতের পালের বাতাস কেড়ে নিতে পেরেছেন মুজিব-কন্যা। মন্ত্রিসভার সদস্য তথা আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘‘বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত-বিরোধী মানসিকতা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। বিএনপি-জামাতের মতো দলগুলি তাকে কাজে লাগিয়েছে। শেখ হাসিনার ভারত-বন্ধু মানসিকতা নিয়ে রাজনীতিও করা হয়েছে। কিন্তু এ বারে নরেন্দ্র মোদী সর্বসম্মত ভাবে স্থলসীমান্ত চুক্তি পাশ করিয়ে নেওয়ায় তাদের ভারত-বিরোধিতার তির সাময়িক ভাবে হলেও ভোঁতা হয়েছে।
জামাতও ভারতের উদ্যোগকে সমর্থন করতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটা একটা বড় পরিবর্তন।’’ পরিবর্তন তো বটেই! সে কারণেই মোদী-খালেদা বৈঠক হতে চলেছে। অথচ এই খালেদাই তো মাত্র বছর দুয়েক আগে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বাংলাদেশ সফরের সময় তাঁর সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠক বাতিল করে দিয়েছিলেন!
এই সফরে সেই বিরোধিতার হাওয়াটাই নেই। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ঘটনা বাংলাদেশের দলগুলির ভারত-নীতির প্রশ্নে একটি বড় পরিবর্তনের সূচকও বটে। ‘বাংলাদেশ রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিকেশন’-এর কর্তা শামসুল আরফিন (যিনি সম্প্রতি মোদীর উপর একটি বই লিখেছেন) বলছেন, ‘‘স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়িত হওয়ার জন্য বাংলাদেশ ৪১ বছর ধরে অপেক্ষা করে রয়েছে। দেশহীনরা তাঁদের পরিচয় ফিরে পেলেন। দু’দেশের ইতিহাসে এর থেকে বড় ব্যাপার আর কি হতে পারে!’’
সূত্র : আনন্দবাজার