সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় হত্যা ও ইমারত নির্মাণ আইনে দায়ের করা দুই মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪২ জনের বিরুদ্ধে দুটি অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। দুই বছর এক মাস পর গতকাল সোমবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি পুলিশের সহকারী সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সংশ্লিষ্ট সাধারণ নিবন্ধন (জিআর) শাখায় অভিযোগপত্র দুটি দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে এক হাজার ১৩৬ জনের প্রাণহানি এবং রানা প্লাজা ধসের আলাদা ঘটনায় আসামিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়েছে। এতে ভবনের মালিকপক্ষ, স্থানীয় প্রশাসন, সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ এবং পাঁচটি কারখানার মালিকপক্ষকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অতিরিক্ত পিপি আনোয়ারুল কবির বাবুল জানান, মামলা দুটির তদন্ত প্রায় ছয় মাস আগে শেষ হলেও শুধু সরকারি মঞ্জুরি আদেশের জন্য আদালতে তা দাখিল করতে পারেনি সিআইডি। ইমারত নির্মাণ আইনের ১৮ জন আসামির মধ্যে ১৭ জনই দণ্ডবিধি আইনের চার্জশিটে রয়েছেন। দুই চার্জশিট মিলে আসামি ৪২ জন। আগামী ২৮ জুন চার্জশিট দুটি আদালতে উপস্থাপন করা হবে।
জানা গেছে, হত্যা মামলায় ৪১ জনকে অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইমারত নির্মাণ আইনে করা মামলায় ১৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। উভয় মামলায় অভিন্ন আসামি ১৭ জন। অভিযোগপত্রের ৪২ আসামির মধ্যে ২৬ জন পলাতক। গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ২২ জনকে। তাঁদের মধ্যে ছয়জনকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। জামিনে আছেন ১৪ জন। জেলহাজতে আছেন রানাসহ দুজন। চার্জশিটের সঙ্গে পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করা হয়েছে।
জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি বিজয় কৃষ্ণ কর বলেন, ‘অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণে খুঁটিনাটি সব বিষয় বিশ্লেষণ করে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখন আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী পলাতকদের সংশ্লিষ্ট পুলিশ গ্রেপ্তার করবে।
সূত্র জানায়, রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা, তাঁর বাবা আবদুল খালেক ও মা মর্জিনা বেগমকে অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে বেআইনিভাবে নকশা অনুমোদন করা, নিম্নমানের মালামাল দিয়ে ভবন নির্মাণ করা, ভবনে ফাটল দেখার পরও সিলগালা না করা এবং ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে প্ররোচিত করার অভিযোগ আনা হয়েছে। রানা প্লাজা ধসের পর মালিক সোহেল রানাকে পালাতে সহায়তা করা এবং আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ আনা হচ্ছে অনিল দাস, শাহ আলম ও আবুল হাসান নামের তিনজনের বিরুদ্ধে।
অভিযুক্ত করা হয়েছে সাবেক পৌর মেয়র রেফাত উল্লাহ, পৌরসভার মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায়, নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, উপসহকারী প্রকৌশলী রকিবুল হাসান, সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, পৌরসভার নগর পরিকল্পনাবিদ ফারজানা ইয়াসমিন ও সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলীকে। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ- অবৈধভাবে ভবনের নকশা অনুমোদন, নির্মাণ ক্ষেত্রে তদারকি না করা এবং ফাটল জানার পরও সে ব্যাপারে ব্যবস্থা না নেওয়া। সূত্র জানায়, নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে ভবন নির্মাণ করা, নির্মাণকাজে সক্রিয় সহযোগিতা করা ও মালিকপক্ষকে সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয়েছে প্রকৌশলী সারোয়ার কামাল, কর্মচারী আতাউর রহমান, আবদুস সালাম, বিদ্যুৎ মিয়া, রেজাউল ইসলাম ও ঠিকাদার নান্টুর বিরুদ্ধে। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত না করা এবং সময়মতো নজরদারি না করার অভিযোগ আনা হয়েছে রাজউকের ইমারত পরিদর্শক আওলাদ হোসেনের বিরুদ্ধে। ভুয়া নকশার ওপর ভিত্তি করে কারখানার অনুমোদন দেওয়ার অভিযোগ আনা হচ্ছে শিল্প-সম্পর্ক শিক্ষায়তনের প্রকল্প পরিচালক বেলায়েত হোসেনের বিরুদ্ধে।
বাণিজ্যিক ভবনে অবৈধভাবে কারখানা স্থাপন করা, ভবনের মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করা, ব্যবসা করা, কারখানা অনুমোদনের জন্য ভবনের ভুয়া নকশা দাখিল করা, অবৈধভাবে লাইসেন্স সংগ্রহ করা, বিধিবহির্ভূতভাবে জেনারেটর বসানো এবং ফাটল দেখার পরও কারখানা সিলগালা না করার অভিযোগ আনা হয়েছে কারাখানা মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে। তাঁরা হলেন- নিউ ওয়েভ বটমস ও নিউ ওয়েভ স্টাইল লিমিটেডের চেয়ারম্যান বজলুল সামাদ আদনান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুর রহমান, ফ্যান্টমের পরিচালক আমিনুল ইসলাম, এ বি এম সিদ্দিক, ইথার টেক্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক জান্নাতুল ফেরদৌস, পরিচালক মনোয়ার হোসেন বিপ্লব, রাকিবুল হাসান ও শফিকুল ইসলাম। এ ছাড়া ফাটল দেখার পরও কর্মীদের চাকরিচ্যুতির ভয় দেখিয়ে কাজে যোগ দিতে বাধ্য করার অভিযোগ আনা হয়েছে কর্মচারী নয়ন মিয়া, আবদুল হামিদ, আবদুল মজিদ, ইউসুফ আলী ও আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে।
মামলার অভিযোগপত্রে শ্রমিকদের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে জোরপূর্বক আটকে রেখে কাজে বাধ্য করা এবং হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা দণ্ডবিধির ৩০২/৩২৬/৩২৫/৩৩৭/৩৩৮/৪২৭/৪৬৫/৪৭১/২১২/১১৪/১০৯/৩৪ ধারার অভিযোগে হত্যা ও ১৯৫২ সালের ইমারত নির্মাণ আইনের ১২ ধারায় দুটি অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এর মধ্যে হত্যা মামলায় ৪১ জনকে অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখানে মামলার বাদী সাভার থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ওয়ালী আশরাফসহ সাক্ষী করা হয়েছে ৫৯৪ জনকে। ইমারত নির্মাণ আইনে করা মামলায় ১৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। এখানে মামলার বাদী রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিনসহ ১৩৫ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।
চার্জশিট দাখিলের সময় হত্যা মামলায় সাভারের তৎকালীন ইউএনও কবির হোসেন সরদার, স্প্যানিশ নাগরিক ডেভিড মেয়র রিকো, সাভার পৌরসভার প্রধান প্রকৌশলী মো. আবদুর রাজ্জাক, নির্বাহী প্রকৌশলী এমতেমাম হোসেন, সহকারী প্রকৌশলী আলম মিয়া, আবদুল মান্নান, রাসেল আহমেদ, আলমগীর হোসেন ও কাজী সাইফুল ইসলামকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন জানানো হয়েছে। অন্যদিকে ইমারত নির্মাণ আইনের মামলার চার্জশিটে নির্বাহী প্রকৌশলী এমতেমাম হোসেন ও সহকারী প্রকৌশলী আলম মিয়াকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা ধসে এক হাজার ১১৭ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরো ১৯ জন মারা যায়। ধ্বংসস্তূপ থেকে দুই হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। তাদের মধ্যে গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গুত্ব¡ বরণ করে ৭৮ জন।
সূত্রঃ কালেরকন্ঠ