পাঁচ বছর আগে পথ দেখিয়েছিলেন রুশনারা আলী; সেই পথ ধরে সংসদীয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার যুক্তরাজ্যের আইনপ্রণেতা হলেন আরও দুই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নারী।
যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে ‘আত্মবিশ্বাসী’ রুশনারার সঙ্গে ‘প্রত্যয়ী’ রূপা হক ও ‘দুর্দান্ত’ টিউলিপ সিদ্দিককে লন্ডনের তিনটি আসন থেকে এমপি নির্বাচিত করেছেন ব্রিটিশ ভোটাররা।
শুক্রবার সকালে ভোটের ফল ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি টিউলিপ বলেন, “এখন আমরা তিন জন বাঙালি মেয়ে পার্লামেন্টে। আমরা যদি একসাথে কাজ করি তবে অনেক কিছু করা যাবে আমাদের কমিউনিটির জন্য।”
এবার মোট ১১ জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রাজনীতিবিদ যুক্তরাজ্যের নির্বাচনে প্রার্থী হলেও বাঙালির এই ‘তিন কন্যার’ কাছেই বাংলাভাষী ভোটারদের প্রত্যাশা ছিল সবচেয়ে বেশি। ব্রিটেনের মূলধারার সংবাদ মাধ্যমও প্রচারের শুরু থেকেই নজর রেখেছিল তাদের আসনগুলোতে।
নির্বাচনে তিনকন্যার জয়ের খবরে অভিনন্দন জানিয়ে আগামী দিনেও তাদের সাফল্য কামনা করেছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাঙালি অধ্যুষিত পূর্ব লন্ডনের বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো আসনে রুশনারা আলীর বিজয় একরকম নিশ্চিতই ছিল। লেবার পার্টি শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় যেতে না পারলেও সিলেটের মেয়ে রুশনারা পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন গতবারের তুলনায় দ্বিগুণ ভোট পেয়ে।
এবার তিনি পেয়েছেন ৩২ হাজার ৩৮৭ ভোট। আর তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ পার্টির ম্যাথু স্মিথ পেয়েছেন মাত্র ৮ হাজার ৭০ ভোট।
২০১০ সালের নির্বাচনে প্রথম ব্রিটিশ-বাংলাদেশি হিসাবে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে পা রাখেন রুশনারা।
সিলেটের বিশ্বনাথে ১৯৭৫ সালে জন্ম নেওয়া রুশনারা মাত্র সাত বছর বয়সে বাবা-মার সঙ্গে লন্ডনে পাড়ি জমান।
৪০ বছর বয়সী এই পার্লামেন্টারিয়ান লেবার পার্টির হয়ে শিক্ষা ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক শ্যাডো মিনিস্টারের দায়িত্বও পেয়েছিলেন। তবে ইরাকে সামরিক হামলায় লেবার পার্টির সমর্থন দেওয়ার প্রতিবাদে গত সেপ্টেম্বরে তিনি ওই দায়িত্ব থেকে সরে যান।
দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ডিগ্রিধারী রুশনারা পরামর্শক সংস্থা ইয়ং ফাউন্ডেশনের একজন সহযোগী পরিচালক। আপরাইজিং নামের একটি দাতব্য সংগঠনেরও নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি।
(ব্রিটিশ পার্লামেন্টের এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর সাংবাদিকদের সামনে টিউলিপ সিদ্দিক)
ভোটের আগে লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসনে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার পূর্বাভাস থাকলেও লেবার পার্টির তরুণ প্রার্থী টিউলিপ জয় পেয়েছেন বেশ সাবলীলভাবেই। প্রথমবার নির্বাচনে দাঁড়ানো বাংলার মেয়ে টিউলিপ ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থীকে পরাজিত করেছেন ১১৩৮ ভোটের ব্যবধানে।
জয়ের পথে টিউলিপ সিদ্দিক পেয়েছেন ২৩ হাজার ৯৭৭ ভোট। আর কনজারভেটিভ পার্টির সায়মন মার্কাস পেয়েছেন ২২ হাজার ৮৩৯ ভোট।
শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট মেয়ে শেখ রেহানা ও শফিক সিদ্দিকের মেয়ে টিউলিপের শৈশব কেটেছে বাংলাদেশ, ভারত ও সিঙ্গাপুরে। ১৫ বছর বয়স থেকে তিনি হ্যাম্পস্ট্যাড অ্যান্ড কিলবার্নে বসবাস করছেন; ওই এলাকায় স্কুলে পড়েছেন ও কাউন্সিলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
লন্ডনের কিংস কলেজ থেকে পলিটিক্স, পলিসি ও গভর্মেন্ট বিষয়ে তার স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়া টিউলিপ লেবার পার্টির সদস্য হন মাত্র ১৬ বছর বয়সে।
যুক্তরাজ্যের এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর খালা শেখ হাসিনার কথা স্মরণ করে টিউলিপ বলেন, “রাজনীতি নিয়ে উনার কাছ থেকেই সব শিখলাম। সোশাল জাস্টিসটা শিখলাম। শিখলাম কীভাবে ক্যাম্পেইন করতে হয়। মানুষের কাছে যেতে হয়। খালাকেই সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে। ফোন করেছি, খালাকে বলেছি খুশির খবরটা।”
টিউলিপ মোটামুটি সহজ জয় পেলেও উত্তর-পশ্চিম লন্ডনের ইলিং সেন্ট্রাল অ্যান্ড অ্যাকটন আসনে কনজারভেটিভ প্রার্থীর সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে লেবারপ্রার্থী রূপা হকের। শেষ পর্যন্ত তিনি জয় পেয়েছেন ২৭৪ ভোটের ব্যবধানে।
প্রায় ৭০ হাজার ভোটারের এই আসনে ২০১০ সালের নির্বাচনে লেবার পার্টির প্রার্থীকে হারতে হয়েছিল তিন হাজার ৭১৬ ভোটের ব্যবধানে। সেই ফল উল্টে দেওয়ার কঠিন কাজটিই করেছেন ড. রূপা।
এবারের নির্বাচনে রূপা পেয়েছেন ২২ হাজার ২ ভোট। আর ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থী এনজি ব্রে ২১ হাজার ৭০১ ভোট পেয়ে হেরেছেন।
৪৩ বছর বয়সী রূপা হক কেমব্রিজে পড়েছেন রাজনীতি, সামাজিক বিজ্ঞান ও আইন বিষয়ে। আর কিংস্টন ইউনিভার্সিটিতে এতদিন পড়িয়েছেন সমাজ বিজ্ঞান, অপরাধ বিজ্ঞান, গণমাধ্যম ও সংস্কৃতি অধ্যয়নের মতো বিষয়। এর আগে ডেপুটি মেয়র হিসাবে স্থানীয় সরকারেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
রূপা হক একাধারে লেখক, মিউজিক ডিজে, কলামনিস্ট হিসাবে পরিচিত। আর তার ছোট বোন কনি হক বিবিসির ব্লু পিটার শো উপস্থাপনার কল্যাণে ব্রিটিশদের কাছে খুবই পরিচিত মুখ।
এর আগে ২০০৫ সালের নির্বাচনে চেশাম ও এমারশাম আসন থেকে লেবার পার্টির মনোনয়ন পেলেও সেবার তিনি নির্বাচিত হতে পারেননি রূপা। এছাড়া ২০০৪ সালে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে নির্বাচনেও প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি।
বিডিনিউজ