বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে ক্ষমতার পালাবদলের ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন ব্রিটিশ এমপিরা।
গতকাল বুধবার ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সের ওয়েস্টমিনিস্টার হলে ‘বাংলাদেশ এবং এর ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক এক বিতর্কে তারা এ কথা বলেন।
এসময় প্রধানমন্ত্রীর সফরকে কেন্দ্র করে গত কয়েক দিন লন্ডনে স্থানীয় বিএনপির বিক্ষোভ এবং সর্বশেষ গত সোমবার ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সামনে দুই পক্ষে উত্তেজনার ঘটনায়ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ব্রিটিশ এমপিরা। তাঁরা বলেছেন, বাংলাদেশের অসহিষ্ণু রাজনীতি বিদেশে থাকা সমর্থকদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে।
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি মেয়র নির্বাচনে অনিয়ম ও ভোট জালিয়াতির অভিযোগ তদন্তে যুক্তরাজ্যসহ আন্তর্জাতিক অংশীদারেরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি নিরপেক্ষ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছিল। এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বিতর্কে হতাশা প্রকাশ করা হয়। মানবাধিকার এবং বাকস্বাধীনতা প্রশ্নে ব্রিটিশ এমপিদের উদ্বেগের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তবে প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনে বেশ ভালো করেছে বলে সন্তোষ প্রকাশ করেন তাঁরা।
দেশটির পার্লামেন্টের বাংলাদেশ-বিষয়ক সর্বদলীয় কমিটির সভাপতি অ্যান মেইন এমপি এ বিতর্কের উদ্যোক্তা। স্থানীয় সময় বেলা আড়াইটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এ বিতর্কে ২০ জনের বেশি এমপি উপস্থিত ছিলেন। বিতর্কে অংশ নেন আটজন। বেশির ভাগ এমপি গত মঙ্গলবার পার্লামেন্টের এক সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের কথা উল্লেখ করেন। এমপিদের প্রশ্নের জবাব দেন পররাষ্ট্রবিষয়ক (ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিস) প্রতিমন্ত্রী হুগো সয়্যার। তবে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তিনজন এমপির কেউ এ বিতর্কের সময় উপস্থিত ছিলেন না।
হাউস অব কমন্সে আইন প্রণয়নের বিষয় নয়-এমন কিছু বিতর্ক মূল অধিবেশনকক্ষে না হয়ে ওয়েস্টমিনিস্টার হলে হয়ে থাকে।
বিতর্কে হুগো সয়্যার বলেন, গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বর্ষপূর্তিকে কেন্দ্র করে নাশকতার ঘটনায় শতাধিক লোক প্রাণ হারিয়েছেন। বিরোধী পক্ষের লোকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যুক্তরাজ্য বারবার দুই পক্ষকে সহনীয় আচরণের আহ্বান জানিয়ে আসছে।
সয়্যার বলেন, রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলার একটি সুযোগ নষ্ট হয়েছে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময়। এই নির্বাচন জালিয়াতি ও সহিংসতার দোষে দুষ্ট ছিল। বাংলাদেশে ব্লগারদের হত্যার ঘটনা উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং বাকস্বাধীনতা পরিস্থিতির লক্ষণীয় কোনো উন্নতি নেই। জামায়াতে ইসলামীর নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ডের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, পরিস্থিতি যা-ই হোক, যুক্তরাজ্য মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করে না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে যুক্তরাজ্য স্বাগত জানায় উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়িত হওয়ায় হাজার হাজার মানুষের দীর্ঘদিনের ভোগান্তি দূর হবে।
বিতর্কের সূচনা বক্তব্যে ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ দলীয় এমপি অ্যান মেইন রাজনৈতিক সংঘাত এবং অস্থিরতাকে বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বিলোপের ঘটনায় অসন্তুষ্ট বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা হ্রাস পেয়েছে বলে তাঁর মন্তব্য। মেইন বলেন, রক্তপাতহীন নির্বাচনের নজির বাংলাদেশে নেই। তবে সর্বশেষ অনুষ্ঠিত সিটি মেয়র নির্বাচনটি ছিল সবচেয়ে দুঃখজনক। অ্যান মেইন আরও বলেন, বাংলাদেশে দুর্নীতি একটি ভয়াবহ সমস্যা। যুক্তরাজ্য বাংলাদেশকে প্রতিবছর যে ২৫ কোটি পাউন্ড সাহায্য দিচ্ছে, তা সঠিক কাজে লাগছে কি না, সেটা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন তিনি।
কেরি ম্যাকার্থি বলেন, বাংলাদেশের অনেক অগ্রগতি আছে, কিন্তু যে কথা বলা প্রয়োজন তা হলো দেশটিতে গণতন্ত্র প্রয়োজন। প্রয়োজন গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে ক্ষমতার পালাবদলের ব্যবস্থা। এর কোনো বিকল্প নেই।
এমপিদের অনেকেই বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের নির্যাতন ও হয়রানির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তাদের সুরক্ষার ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতার জন্য বিএনপির প্রধান খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সরকার অভিযোগ এনেছে উল্লেখ করে তাঁরা বলেন, এই অভিযোগের নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।
কনজারভেটিভ দলীয় এমপি মার্ক ফিল্ড অতীতকাতর রাজনীতি অগ্রগতির জন্য শুভ নয় বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, এটা সত্য, ৪৪ বছর আগে যে গুরুতর অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল, তার বিচার একটা পর্যায় পর্যন্ত নিশ্চিত করা যেমন জরুরি, তেমনি সমঝোতার মাধ্যমে এর ইতি টানার বিষয়টিও জরুরি।
বাংলাদেশের পোশাকশ্রমিকদের অধিকার, শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির প্রভাবের মতো বিষয়গুলোও গুরুত্ব পায় আলোচনায়। এমপিরা বলেন, একদিকে পোশাকশ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা যেমন জরুরি, তেমনি দুর্ঘটনা রোধে অবকাঠামো নির্মাণেও সঠিক নিয়ম মানা জরুরি। তাঁরা বলেন, অবকাঠামো তৈরিতে দুর্নীতি রোধ করা না গেলে ভবনধসের মতো দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে না। শ্রমিক সংগঠনগুলোর বিভক্তিকেও তাঁরা শ্রমিক অধিকার নিশ্চিতের ক্ষেত্রে বড় বাধা বলে চিহ্নিত করেন।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যা এবং সাম্প্রতিক মানব পাচারের বিষয়েও আলোচনা হয়। বক্তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে কাজ করার সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ-বিষয়ক আলোচনায় অন্যদের মধ্যে অংশ নেন লেবার দলের জোনাথন রেনল্ডস, কেরি ম্যাকার্থি ও এসএনপির তাসমিনা আহমদ শেখ।