ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন ছাত্রলীগের ২৮তম সম্মেলন আগামী ২৫-২৬ (শনিবার-রোববার) জুলাই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বর্তমান কমিটির মেয়াদোত্তীর্ণের দুই বছর পর আগামী দুই বছরের জন্য নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের উদ্দেশ্যে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
কারা আসছেন নতুন নেতৃত্বে? সামনে রেখে এখন তা নিয়ে চলছে নানান হিসাব-নিকাশ। গত ৮ মে সম্মেলনের তারিখ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই পদপ্রত্যাশীরা শুরু করেছেন দৌড়ঝাঁপ। ছাত্রলীগের বর্তমান শীর্ষ নেতৃত্বের পাশাপাশি তারা ধর্ণা দিচ্ছেন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারকারী সাবেক নেতাদের কাছে।
শেষ পর্যন্ত কাদের ভাগ্যের শিকে ছিঁড়বে তা নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। আর এতে সামনে আসছে নানা সমীকরণ।
তবে এ বছর সম্মেলনে কাউন্সিলরদের সরাসরি ভোটে না-কি সমঝোতার মাধ্যমে নেতা নির্বাচন করা হবে তা নিয়ে এখনো স্পষ্ট করে কিছু জানানো হয়নি।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ছাত্রলীগ সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ বলেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আমরা সম্মেলনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। তবে শেষ সিদ্ধান্ত নেবেন নেত্রীই (শেখ হাসিনা)।
বেশ কিছু বিষয় মাথায় রেখে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অঞ্চলভিত্তিক রাজনীতি। যে অঞ্চলে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের তেমন কোনো নেতা নেই সেসব অঞ্চলই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রাধান্য পায়। প্রাধান্য পায় বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চল। এছাড়া সম্মেলনের প্যানেল নির্বাচনে সক্রিয় ভূমিকা থাকে বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ সাবেক কয়েকজন নেতারও। গত কয়েকটি কমিটিতে তেমনটাই দেখা গেছে।
কেন্দ্রীয় দুই শীর্ষ নেতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শাখার দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে অন্তত একজন বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চল থেকে নির্বাচিত হন। বিষয়টি ছাত্রলীগের অনেকটা অলিখিত নিয়ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আগের দুই কমিটির সভাপতিও ছিলেন বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলের। এর মধ্যে ২০১১-২০১৫ সাল পর্যন্ত সভাপতি ছিলেন মেহেদী হাসান মোল্লা (মাদারীপুর)। এর আগের কমিটির সভাপতি ছিলেন শেখ সোহেল রানা টিপু (রাজবাড়ী)।
ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন বরিশাল অঞ্চলের আবিদ আল হাসান এবং বর্তমান কেন্দ্রীয় সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগের জেলা বাগেরহাটের মোতাহার হোসেন প্রিন্স হয়েছেন সাধারণ সম্পাদক।
সুতরাং আসন্ন সম্মেলনে কেন্দ্রীয় দুই শীর্ষ নেতার অন্তত একজন যে ফরিদপুর অঞ্চল থেকেই নির্বাচিত হচ্ছেন এমন আলোচনা শোনা যাচ্ছে বেশ জোরেশোরেই।
এছাড়া কেন্দ্রীয় কমিটিতে আনতে ফরিদপুর অঞ্চল থেকে এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ নেতৃত্বে কাউকে আনা হয়নি বলে জানিয়েছেন ছাত্রলীগের একাধিক বর্তমান ও সাবেক নেতা। এক্ষেত্রে এ অঞ্চলের বর্তমান ও সাবেক নেতারা ‘ছাড়’ দিয়েছেন বলেও চাউর আছে।
বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চল থেকে শীর্ষ নেতৃত্বে আসার দৌড়ে রয়েছেন বর্তমান কমিটির সমাজ সেবা সম্পাদক কাজী এনায়েত হোসেন (গোপালগঞ্জ), বর্তমান কমিটির পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক এবং জিয়া হলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান সোহাগ (মাদারীপুর), এফ রহমান হলের বর্তমান সভাপতি সায়েম খান (গোপালগঞ্জ) এবং বর্তমান কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন আনু (গোপালগঞ্জ)।
এছাড়া এ অঞ্চল থেকে আরও মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন সুর্যসেন হলের সাধারণ সম্পাদক আরেফিন সিদ্দিক সুজন (মাদারীপুর), কবি জসীম উদদীন হলের সাধারণ সম্পাদক বিএম এহতেশাম (রাজবাড়ী), জহুরুল হক হল শাখার সভাপতি রিফাত জামান (গোপালগঞ্জ), সদ্য বিলুপ্ত ঢাবি শাখার সহ-সভাপতি এনায়েত হোসেন রেজা (ফরিদপুর), যুগ্ম সম্পাদক সাকিবুল আহসান সম্রাট (ফরিদপুর), বর্তমান কমিটির উপ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক গোলাম রাব্বানি (মাদারীপুর) প্রমুখ।
ছাত্রলীগ সূত্রে জানা যায়, ১/১১ পরবর্তী সময়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা, আন্দোলন সংগ্রামে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখাসহ ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডেও সক্রিয় ছিলেন কাজী এনায়েত। স্বচ্ছ রাজনীতিক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তার সুনামও রয়েছে। এসব বিবেচনায় এগিয়ে আছেন তিনি।
তবে তার বাড়ি গোপালগঞ্জ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে পড়তে পারেন এনায়েত। কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ গোপালগঞ্জের একাধিক নেতা আওয়ামী লীগে ইতোমধ্যেই প্রভাবশালী। তাই ছাত্রলীগের ইতিহাসে সংগঠনটির শীর্ষ নেতৃত্বে গোপালগঞ্জের কেউ এখনও নির্বাচিত হতে পারেননি।
একই কারণে পিছিয়ে পড়তে পারেন ‘মেধাবী ছাত্রনেতা’ খ্যাত সায়েম খান এবং আনোয়ার হোসেন আনুও। কারণ এই দুই নেতার বাড়িও গোপালগঞ্জ।
তবে পদপ্রত্যাশী এই নেতারা জানান, এর আগে গোপালগঞ্জ থেকে কেউ নির্বাচিত হয়নি বলে যে এবারও হবে না সে রকম কোনো কথা নেই। আশা করি যোগ্য এবং নিবেদিত প্রাণরাই ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসবেন, তিনিই যে অঞ্চলেরই হউন না কেন।
অন্যদিকে বর্তমান কমিটির বিভিন্ন কর্মসূচিতে সক্রিয় অংশগ্রহণসহ বর্তমান কমিটির সভাপতি এইচ এম বদিউজ্জামান সোহাগ এবং ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সবচেয়ে প্রভাবশালী সাবেক সভাপতি লিয়াকত শিকদারের কাছের লোক হিসেবে পরিচিত সাইফুর রহমান সোহাগের সম্ভাবনাও বেশি।
তবে জিয়া হল থেকে ইতোমধ্যেই ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মোতাহার হোসেন প্রিন্স বেরিয়ে আসায় বিপাকে পড়তে পারেন এই হলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সোহাগ। কারণ একই হল থেকে দু’জনকে শীর্ষ পদে সাধারণত দেখা যায়না।
অন্যদিকে সোহাগ ও ঢাবি ছাত্রলীগের সদ্য বিদায়ী সভাপতি মেহেদী হাসান মোল্লা উভয়ই মাদারীপুরের। কিন্তু একই জেলা থেকে ছাত্রলীগের শীর্ষ চারে পরপর দু’বার নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা বিরল। এই কারণে পিছিয়ে পড়তে পারেন সোহাগ। একই জেলায় বাড়ি হওয়ায় পিছিয়ে পড়তে পারেন মাদারীপুরের অপর দুই নেতা আরেফিন সিদ্দিক সুজন এবং গোলাম রাব্বানীও।
তবে সাইফুর রহমান সোহাগের দাবি, কেন্দ্রীয় কমিটি আর ঢাবি কমিটির হিসাব সম্পূর্ণ আলাদা। তাই হল বা অঞ্চল এক্ষেত্রে বিবেচনায় আসবে না।
ফরিদপুর অঞ্চলের বাইরে যারা আলোচনায় রয়েছেন তারা হলেন, ঢাকা মহানগর উত্তরের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আজিজুল হক রানা, ঢাবি শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এইচ এম আল-আমিন আহমেদ, কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সম্পাদক আসাদুজ্জামান নাদিম, জাকির হোসেন, বিপ্লব হাসান পলাশ, উপ-স্কুলছাত্র বিষয়ক সম্পাদক ইমতিয়াজ বাপ্পি, কৃষি বিষয়ক সম্পাদক এরশাদুর রহমান চৌধুরী, কেন্দ্রীয় সদস্য এনামুল হক প্রিন্স, গণযোগাযোগ সম্পাদক ওয়াহিদুর রহমান জয়, ঢাবির প্রচার সম্পাদক শাহেদ প্রমুখ।
এদিকে ভোট না হয়ে যদি সমঝোতার কমিটি করা হয় সেক্ষেত্রে ভাগ্য খুলে যেতে পারে বর্তমান কমিটির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামসুল কবির রাহাতের।
তবে, গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সময় মাঠে সক্রিয় ছিলেন এমন নেতাদের মধ্য থেকেই নেতা নির্বাচিত হবে বলে জানিয়েছেন বদিউজ্জামান সোহাগ।
তিনি বলেন, হয় নেত্রী (শেখ হাসিনা) নেতা নির্বাচন করবেন, না হয় কাউন্সিলররা। তবে ৫ জানুয়ারির ভূমিকা অবশ্যই প্রাধান্য পাবে বলে আশা তার।
সূত্রঃ বাংলানিউজ