‘জীন-ভূতের আছর, বদ বাতাস লাগা’

ডা: জিনাত ডি লায়লা :

গ্রামগঞ্জে এই অসুখটি বিভিন্ন নামে পরিচিত। এটিকে জীন-ভূতের আছর, বদ বাতাস লাগা ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়। যে নামেই ডাকা হোক না কেন এর সব চেয়ে বড় অসুবিধা, সাধারণ জনগণ এই রোগের চিকিৎসা নিতে আগ্রহী হন না। এতে রোগীর সারা জীবন নষ্ট হয়ে যায়।
লিখেছেন ডা: জিনাত ডি লায়লা

প্রতি হাজারে ছয়জন মানুষের মধ্যে এ রোগ হয়। শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এই রোগের প্রবণতা বেশি থাকে। বড়দের ক্ষেত্রেও এ রোগ হতে পারে, তবে খুব কম।

এপিলেপ্সি কাকে বলে
আমাদের মগজে কয়েক শ’ কোটি স্নায়ুতন্ত্র রয়েছে। একেক স্নায়ুতন্ত্রের রয়েছে একেক ধরনের কাজ। সব স্নায়ুতন্ত্রের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের মস্তিষ্ক। এই মস্তিষ্কের কোনো একটি কোষ যদি বিদ্রোহী হয়ে তার কার্যক্রম স্বাধীনভাবে পরিচালনা করতে চায় তাহলে সব স্নায়ুতন্ত্রের কাজকর্ম এলোমেলো হয়ে যায়। তখনই শরীরে নানা ধরনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, ফলে সারা শরীরে খিঁচুনি তৈরি হয় এবং তার পরবর্তীতে রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়, তারই নাম মৃগীরোগ বা এপিলেপ্সি।

এপিলেপ্সির প্রকার ভেদ
খুব সাধারণভাবে এটিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়
১. আংশিক খিঁচুনি মৃগীরোগ; ২. পূর্ণ খিঁচুনি মৃগীরোগ।
আংশিক খিঁচুনি রোগে মস্তিষ্কের কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যায়। তাতে বিভিন্ন প্রকার উপসর্গের সৃষ্টি হয়। এই রোগে রোগী অজ্ঞান হতেও পারে আবার নাও হতে পারে।
পূর্ণ খিঁচুনি রোগে মগজের সব এলাকাই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যায়। ফলে প্রথমে শারীরিক খিঁচুনি হওয়ার পর রোগী অজ্ঞান হয়ে যায়।

এপিলেপ্সি রোগের কারণ
এপিলেপ্সি বা মৃগীরোগের কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা যে কারণগুলোর কথা বলেন তার প্রথম কারণ: অজানা। এ ছাড়া আরো কারণ যেমন- জন্মকালীন মস্তিষ্কে আঘাতপ্রাপ্তরা, জন্মকালীন অঙ্গহানি, মেটাবলিক কারণ, বিভিন্ন ধরনের ইনফেকশন, ব্রেন টিউমার, মাথায় আঘাতপ্রাপ্ততা ও বিভিন্ন ধরনের মস্তিষ্ক-রক্তনালীল অসুখ। এ ছাড়া কিছু কিছু ওষুধ যেমনÑ মানসিক রোগের ওষুধ, বিষণœতাবিরোধী ওষুধগুলো খিঁচুনি তৈরি করতে পারে। বিভিন্ন ধরনের ড্রাগ্সের দ্বারা এপিলেপ্সি হতে পারে। মদ সেবন এপিলেপ্সি রোগের অন্যতম একটি কারণ।

এপিলেপ্সিতে কী হয়
এপিলেপ্সিতে বা খিঁচুনি রোগের কয়েকটি ধাপ রয়েছে। এই ধাপগুলোর মধ্যে একটি ধাপ রোগীর শরীরে খিঁচুনি হওয়া। এ ছাড়া খিঁচুনি পূর্ববর্তী কিছু সময় রোগীর আবেগ ও অনুভবে কিছু পরিবর্তন হয়। সে নানা ধরনের অলীক প্রত্যক্ষণের মুখোমুখি হতে পারে, তার ধারণা, তার আশপাশের পরিবেশ সহসা পরিবর্তিত জয়ে গেছে, গায়েবি কিছু ঘ্রাণ কিংবা গায়েবি কিছু কথাবার্তাও শুনতে পায়। এর পরেই তার শরীরের সব মাংসপেশি যেমন- মুখমণ্ডল ও হাত-পা টানটান হয়ে যায়। এ অবস্থায় কিছুক্ষণ থাকার পর রোগীর শরীরে খিঁচুনির সৃষ্টি হয় তার হাত-পা, পেটের পেশি ও মুখোমণ্ডলের মাংসপেশি ছন্দময়ভাবে খিঁচতে থাকে। রোগী অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যায়, দাঁতে দাঁত লেগে যায়, জিহ্বা কেটে যায়, মুখ দিয়ে ফেনা পড়ে, মুখোমণ্ডল নীল হয়ে যায় এবং অনেক ক্ষেত্রে রোগী প্রস্রাব কিংবা পায়খানা করে ফেলে। অজ্ঞান অবস্থায় ১ কিংবা ২ মিনিট থাকার পর রোগীর স্বাভাবিক জ্ঞান ধীরে ধীরে ফিরে আসে।

চিকিৎসাব্যবস্থা
রোগীর চিকিৎসা করার আগে বিভিন্ন উপসর্গের মাধ্যমে এপিলেপ্সি বা মৃগী রোগটি নির্ণয় করে নিতে হয়। উপসর্গ ছাড়াও রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সাহায্যকারী হিসেবে ইইজি ও সিটি স্ক্যান অব ব্রেন সচ্ছল রোগীদের ক্ষেত্রে করে নেয়া যায়। যেকোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে কিংবা স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে কিংবা সাধারণ চিকিৎসকের কাছেও এ রোগের চিকিৎসা করা যায়। মৃগীরোগের চিকিৎসার জন্য বর্তমানে অনেক ওষুধ ব্যবহৃত হচ্ছে। একটি বহুল ব্যবহৃত ওষুধ : কার্বামাজেপিন এই রোগ থেকে মুক্তি এনে দিতে পারে। মাত্রাটি আপনার চিকিৎসক নির্ধারণ করে দিবেন। নির্ধারিত মাত্রায় এটি কমপক্ষে তিন বছর কোনোরূপ ফাঁকি না দিয়ে খেতে ব্যর্থ না হয়ে সেবন করতে হবে। রোগীকে মনে রাখতে হবে এই ওষুধটি তার জীবনের ‘কোরামিন’। ওষুধ খাওয়ায় কোনোরূপ ব্যর্থতা এই মৃগীরোগ বা এপিলেপ্সি দীর্ঘায়িত হতে সাহায্য করে। শতকরা ৮০ ভাগ ক্ষেত্রেই মাত্র একটি ওষুধেই রোগটি সেরে যায়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে একাধিক ওষুধের প্রয়োজন হয়।

মৃগীরোগ ও মৃগীজনিত মানসিক রোগ
মৃগীরোগ একটি জটিল রোগ এবং মৃগীরোগ পরবর্তীতে বেশ কিছু রোগীর নানা রকম মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। প্রতি হাজারে ছয়জন মানুষের এ রোগ হয়। এই রোগের বৈশিষ্ট্য খিঁচুনি হওয়া ও অজ্ঞান হয়ে যাওয়া। খিঁচুনিকালীন অবস্থায় ছন্দময়ভাবে হাত-পা খিঁচতে থাকে। দাঁতে দাঁত লেগে যায়। জিহ্বা কেটে যায়, মুখ দিয়ে ফেনা আসে। শরীরের বড় বড় পেশি খিঁচতে থাকে, মুখোমণ্ডল নীল হয়ে যায় এবং কতক ক্ষেত্রে প্রস্রাব-পায়খানা হয়ে যায়। পরে রোগী জ্ঞান হারা হয় এবং জ্ঞান ফিরলে আগে কী ঘটেছিল তা মনে করতে পারে না।

মৃগীরোগ যেকোনো বয়সেই হতে পারে, তবে শিশু বয়সে বেশি হয়। এটি কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। যেহেতু রোগের সাথে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ার একটি সম্পর্ক আছে। তাই মৃগী রোগীদের শরীরে বা মাথায় আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অজ্ঞান হয়ে যায় বলে রোগীকে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় যেমন- নদীতে বা পুকুরে সাঁতার কাটা, গাছে ওঠা, আগুনের কাছে বা চলমান যন্ত্রের কাছ থেকে বিরত রাখতে হবে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে মৃগীরোগ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ ও মানসিক রোগের ওষুধ এক সাথে সেবন করতে হয়। মৃগীরোগের চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য খিঁচুনি বন্ধ করা। তাই এই রোগের ওষুধ বেশি দিন খেতে হয়। মৃগীরোগ সম্বন্ধে আমাদের সমাজে কতগুলো ভুল ধারণা প্রচলিত আছে, যেমন- খারাপ বাতাস লাগা, বিভিন্ন জিনিসের আছর ইত্যাদি।
মৃগীরোগের কারণে বিভিন্ন মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। এগুলোর মধ্যে-
হিস্টিরিয়া রোগের খিঁচুনিকে অনেক সময় মৃগীরোগের খিঁচুনি বলে ভুল করা হয় এবং অনেক সময় উল্টোটা হয়ে থাকে।

হিস্টি রোগে রোগী পূর্ণ চেতনা হারায় না বা অজ্ঞান হয় না। যদিও মনে করা হয় সে জ্ঞান হারিয়েছে। মৃগীরোগে রোগী সম্পূর্ণ চেতনা হারায়। হিস্টিরিয়া রোগের খিঁচুনি সাধারণত লোকজনের উপস্থিতিতে হয়। মৃগীরোগের খিঁচুনি একা একা হতে পারে। হিস্টিরিয়া রোগের খিঁচুনি ঘুমের মধ্যে হয় না। মৃগীরোগের খিঁচুনি জাগ্রত অবস্থায় ও ঘুমের মধ্যে হতে পারে। হিস্টিরিয়ার খিঁচুনির সময় জিহ্বা কাটে না, কাপড়-চোপড়ে প্রস্রাব-পায়খানা হয় না। মৃগীরোগের খিঁচুনিতে জিহ্বা কাটে ও কাপড়-চোপড়ে প্রস্রাব-পায়খানা হয়। হিস্টিরিয়া রোগের খিঁচুনিতে রোগী পড়ে যায় না ও খিঁচুনি অনেকক্ষণ ধরে থাকতে পারে। মৃগীরোগের খিঁচুনিতে রোগী যেহেতু যেকোনো জায়গায় পড়ে যেতে পারে এবং আঘাত পেতে পারে। মৃগীরোগের খিঁচুনি ২ মিনিটের বেশি থাকে না।

কেন করবেন চিকিৎসা

প্রথম কথা চিকিৎসা খুব সহজলভ্য ও কম ব্যয়সাধ্য। এর চিকিৎসা না করালে প্রাণহানি তো বটেই, অনেক ক্ষেত্রে রোগী ‘জীবিত-মৃত’ অবস্থায় থাকে। বিশেষ করে চিকিৎসা না নেয়া কিশোর-কিশোরীদের জীবন থাকে হুমকির মুখে। যার চিকিৎসা এত সহজ তার চিকিৎসা না করে ওই অবস্থায় রেখে দেয়া বা বিভিন্ন অপচিকিৎসার সাহায্য নেয়া এক ধরনের সামাজিক অপরাধ।

লেখিকা : সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
চেম্বার : উত্তরা ল্যাবএইড, ইউনিট-২, সেক্টর-১৩, উত্তরা, ঢাকা।

Exit mobile version