সীমান্ত বিল পাস হয়েছে মোদির জেদেই: বিজেপি

সীমান্ত বিল পাস করিয়েই বাংলাদেশ সফরে যাওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জেদ ধরেছিলেন। প্রধানত, তাঁর জন্যই রাতারাতি সব বাধা কাটিয়ে এই বিল বিনা বাধায় পাস করা সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ও ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের পরিচালক রাম মাধব। বাংলাদেশ-ভারত ষষ্ঠ মৈত্রী আলোচনায় অংশ নিয়ে গতকাল শনিবার এই কথা জানানোর পাশাপাশি তিনি বলেন, ‘আমার মতো আমাদের দলে অনেকেরই এই বিল নিয়ে আপত্তি ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দৃঢ়তা ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের ঐকান্তিকতার দরুন এই বিষয়ে ঐকমত্য আনা সম্ভব হয়েছে। দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা এক ঐতিহাসিক মাইলফলক।’
সীমান্ত বিল এবং প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ঢাকা সফরের আগে এই আলোচনা আক্ষরিক অর্থেই তাই সফরকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। গতকাল দিনভর আলোচনার শুরুতে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব এস জয়শঙ্কর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিভিন্ন দিকের উল্লেখ করে বলেন, ‘দুই দেশের সামনে দুটি রাস্তা রয়েছে। একটি ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, সংশয় ও সন্দেহ নিয়ে বাস করা, যাতে কোনো দেশই জেতার অবস্থায় থাকবে না; অন্যটি সহযোগিতা ও বিশ্বাসের বহর বাড়িয়ে দুই দেশেরই জেতার সম্ভাবনা। আমরা দ্বিতীয় পথের যাত্রী হতে চাই, যেখানে দুজনেই জয়ী হবে।’
এই সুরই প্রতিধ্বনিত হয় ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের কণ্ঠে। দোভাল বলেন, মোদি ক্ষমতায় আসছেন, এটা বোঝার পর বাংলাদেশের অনেকেই উদ্বেগের মধ্যে পড়েছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, আওয়ামী লীগ ও কংগ্রেসের দীর্ঘ সম্পর্কের ছেদ ঘটলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। বাংলাদেশের একটি সংবাদপত্রে এক নিবন্ধে এই উদ্বেগের উল্লেখ করে দোভাল বলেন, ‘এক বছরের মধ্যেই সেই উদ্বেগ উবে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কথা ও কাজের সামঞ্জস্য সম্পর্কে প্রতিবেশীদের মনে স্পষ্ট ধারণার জন্ম হলো। বাংলাদেশের অনেকেই এখন মনে করছেন, এই একটা বছরের মতো সুসময় আগে আসেনি। সহযোগিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ভারত এখন একে অন্যের পরিপূরক।’
দোভাল বলেন, ‘গণতন্ত্রের অনেক সুবিধার মতো একটি অসুবিধাও রয়েছে। এই ব্যবস্থায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে দেরি হয়। পারস্পরিক বিশ্বাস সেই বিলম্বকে ছাপিয়ে যেতে পারে। দুই দেশকে এখন থেকে সেই লক্ষ্যে কাজ করতে হবে।’
বাংলাদেশ-ভারত ষষ্ঠ মৈত্রী বৈঠক শেষে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার বিকাশে গতকাল সন্ধ্যায় দিল্লি ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। তাতে প্রধানত তিনটি ক্ষেত্রে যথাসম্ভব কম সময়ে সহযোগিতা বৃদ্ধিতে সুসংহত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে দুই দেশকে সক্রিয় ভূমিকা নিতে বলা হয়েছে। এই তিনটি বিষয়ের মধ্যে রয়েছে নিরাপত্তা ও আস্থাবর্ধক ব্যবস্থা গ্রহণ, যার মধ্য দিয়ে সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় উন্নতি ঘটিয়ে সীমান্ত এলাকার অপরাধ ও মাদকের কারবার বন্ধ করা যায়। দ্বিতীয় বিষয়টি সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, যার অঙ্গ অবকাঠামো নির্মাণ। তৃতীয় বিষয়টি দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এক সুসংহত পানি ও বিদ্যুৎ নিরাপত্তা তৈরি করা। দুই দিনব্যাপী আলোচনায় এই বিষয়গুলো নিয়ে চর্চায় যা উঠে এসেছে, সবকিছুই দুই দেশের সরকারের কাছে তুলে দেওয়া হবে, যাতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক পর্যায়ে অর্থনৈতিক সংহতি দৃঢ় হতে পারে।
মৈত্রী ও সম্প্রীতির পথে একটা বড় বাধা হিসেবে উঠে আসে ভিসা ও সীমান্ত হত্যা প্রসঙ্গ। অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আবদুর রশিদ বলেন, এই স্পর্শকাতর বিষয়টির সমাধান বহু আলোচনার পরও হলো না। সমস্যার উল্লেখ করে কলকাতার মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউটের পরিচালক শ্রীরাধা দত্ত বলেন, সীমান্তের ১৫ কিলোমিটারজুড়ে অঞ্চলের অপরাধপ্রবণতা না কমানো গেলে সীমান্ত হত্যাও বন্ধ হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম মনে করেন, সীমান্ত অপরাধের মূল কারণ দারিদ্র্য। ভিসা সমস্যা যে সুসম্পর্কের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে তার উল্লেখ করে সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দরকুমার গুজরাল ভিসাহীন যাতায়াতের স্বপ্ন দেখতেন। দেখা গেল তাঁর সেই স্বপ্ন সাকার হতে চলেছে। বাংলাদেশের এক রাজনীতিক বিনা ভিসায় মেঘালয়ে নিজেকে আবিষ্কার করলেন, যেখানে সাধারণ শান্তিপ্রিয় মানুষদের ভিসা পেতে কালঘাম ছুটে যায় অথচ গরু পাচারকারীদের তার প্রয়োজন নেই। অজিত দোভাল বলেন, ভারত বছরে সাড়ে ছয় লাখ বাংলাদেশিকে ভিসা দেয়। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেণ রিজিজু জানান, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিশেষ সমস্যা ও ভিসা-সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে সুপারিশগুলো তাঁর কাছে পাঠাতে, যাতে সমস্যাগুলোর আরও সুরাহা করা যায়।
তিস্তা চুক্তির বিষয়টি গতকালও বারবার উঠে আসে। পররাষ্ট্রসচিব জয়শঙ্কর বলেন, তিস্তা ও ফেনী নদীর পানিবণ্টন নিয়ে আলোচনা চলছে। মোদির সফরে তা সই হবে কি না, সে বিষয়ে তিনি স্পষ্ট করে কিছু বলতে অস্বীকার করেন। শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘আমরা এই চুক্তির জন্য চাপাচাপি করছি না। কারণ, বিষয়টি আলোচনাধীন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেছেন তাঁর ওপর ভরসা রাখতে।’ তবে তিনি জানান, ভারতীয় শিল্পপতিদের জন্য বাংলাদেশে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হবে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, অভিন্ন নদীগুলোর মধ্যে ৫০টি শুধু ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। দুই দেশের মধ্যে নদী কমিশন রয়েছে। দুই দেশকেই নদী ব্যবস্থাপনায় দ্রুত সহযোগিতার রাস্তায় হাঁটতে হবে। এ জন্য গর্ব ও ছুতমার্গিতা ছেড়ে সচেতনতা ও সংবেদনশীলতা বেশি প্রয়োজন। ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্সের চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদও সেই সুরে বলেন, নদীর পানিবণ্টন নয়, নদীর অববাহিকার ব্যবস্থাপনাই জরুরি।
গতকালের মৈত্রী আলোচনায় অংশ নেন ভারতের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল আফসার করিম, সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সাবেক পরিচালক এম এল কুমাওয়াত, অ্যাম্বাসাডর মোহাম্মদ জমির, সাংসদ পঙ্কজ দেবনাথ, সাংসদ আবদুল ওয়াদুদ, অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের পরিচালক সঞ্জয় যোশি, এশিয়া ফাউন্ডেশনের মন্দাকিনি সুরি, আইডিএসএর শেবন্তী রায় দাদওয়াল, অধ্যাপক প্রবীর দে এবং সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি।

সূত্রঃ প্রথমআলো

Scroll to Top