তালেবান যেভাবে ১০ দিনে আফগানিস্তান দখল করলো

তালেবান যেভাবে ১০ দিনে আফগানিস্তান দখল করলো

দখল শুরুর মাত্র ১০ দিনে আফগানিস্তান কব্জায় নিয়েছে তালেবানরা। গত ২০ বছর ধরে তালেবানরা আফগানিস্তানে পুনরায় ক্ষমতায় আসার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেই চেষ্টার সফলতা আসল মাত্র ১০দিনে। সকলের মনেই কৌতুহল হচ্ছে যে এত তাড়াতাড়ি কীভাবে তারা আফগানিস্তান দখল করলো?
আর এটাকে আফগানিস্তানের জনগণ কীভাবে দেখছে?

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা

জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পরে গত এপ্রিলে ঘোষণা দেন যে, আমাদের যুদ্ধ শেষ করার সময় এসেছে। এরপর থেকে আমেরিকান ন্যাটো সেনাদের ফিরিয়ে নেওয়া শুরু করে। ন্যাটো সেনাদের সবচেয়ে বড় ঘাটি ছিল বাগরামে। বাগরাম থেকে জুলাই মাসের ৪ তারিখ রাতের আঁধারেই চলে যায় সেনারা। অনেকে মনে করেন তালেবানদের হুমকির মুখে আমেরিকার ন্যাটো সেনারা পালিয়ে গেছে।
ন্যাটো সেনারা ফিরে গেলেও আফগানিস্তানকে রক্ষা করতে আফগানিস্তানের সেনাদের অস্ত্রশস্ত্র এবং ট্রেনিং-এর পেছনে ৮০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে তারা। কিন্তু তা কোনো কাজেই আসেনি।

হোয়াইট হাউস থেকে বাইডেন বলেছেন- আফগানিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা ছেড়ে দিয়েছেন এবং দেশ থেকে পালিয়েছেন। তাদের সেনাবাহিনী ভেঙে পড়েছে। কোথাও যুদ্ধ করার চেষ্টাও করেনি তারা। আমরা লাখ লাখ সদস্যের সেনাবাহিনীকে ট্রেনিং করিয়ে অস্ত্র দিয়ে শক্তিশালী করেছি। আমরা বার বার মনে করিয়ে দিয়েছি তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। কিন্তু আমরা তাদের সেই ভবিষ্যতের জন্য লড়াই করার ইচ্ছা প্রদান করতে পারিনি।

আমেরিকার ব্রোকিং ইনস্টিটিউট -এর রিসার্চার বলেন, আফগানিস্তানের সেনাদের মনোবল তুষারপাতের মতো ভেঙে পড়েছে। যেখানে তালেবানদের প্রথম দিকে সফলতার দৃশ্যমান হয়েছে, সেখানে সেনারা প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। ন্যাটো সেনারা ফেরার জন্য তাদের সেনাদের তৈরি করা হয়েছিল। তবে আফগান সেনাবাহিনী, পুলিশ, রাজনৈতিক ব্যক্তিরা, এমনকি সেনাবাহিনীর প্রধানও মনে করেছেন যুদ্ধের চেয়ে ছেড়ে দেওয়াই ভালো।

আফগানিস্তান দখল যেভাবে শুরু

বাইডেনের সেনা প্রত্যাহারের পরেই তালেবানরা আফগান সেনাদের একেকটি এলাকা থেকে হটাতে শুরু করে। এরপর বাগরাম ঘাটি থেকে ৪ জুলাই সেনারা চলে যাওয়ার পর ছোট ছোট এলাকা দখল নেওয়া শুরু করে। সর্বপ্রথম আগস্টের ৬ তারিখ প্রথম প্রদেশ জারান’জ দখল করে। ৭ তারিখে সেহবাগ দখল করে একের পর এক প্রদেশ দখল করতে থাকে। কুন্দুস, গজনি ও লস্কর গাও দখল করে উত্তর অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয় তালেবান।
১ সপ্তাহের মধ্যেই আফগানিস্তানের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বড় শহর কান্দাহার ও হেরাত দখল করে। এরপরে একেকটি প্রদেশ দখল করে রাজধানীর দিকে এগুতে থাকে। ১৫ তারিখে জালাবাদ তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে রাজধানী কাবুলের চারপাশ ঘিরে ফেলে। রাজধানী ঘিরে ফেলার পরে তারা আলোচনায় বসে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে।
এরপর বিকেলেই দেখা যায় তালেবান যোদ্ধারা প্রসিডেন্টের বাসভবনে। ক্ষমতা হস্তান্তর হতে মাত্র কয়েক ঘন্টা সময় লেগেছে।

আফগান জনগণের মাঝে অস্থিরতা

আফগানিস্তান জনগণের মধ্যে হঠাৎ অস্থিরতা বেড়ে যায়। তারাও ভাবতে পারেনি এত দ্রুতই তালেবানরা রাজধানী দখল করে ফেলবে। আফগানিস্তানে শুরু হয় ব্যাংক থেকে টাকা তোলার হুড়োহুড়ি। ভিসা অফিসের সামনেও ভিড় করে দেশ ত্যাগ করার জন্য।
লাগেজ কিনতেও ভিড় করে মানুষ। মানুষ কে কী করবে তা-ই বুঝতে পারছিল না।

আমেরিকা তাদের দূতাবাস থেকে মানুষদের ফিরিয়ে নিতে সেনাবাহিনী পাঠায়। সন্ধ্যায় আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গানি পালিয়ে যান। প্রেসিডেন্ট পালিয়ে যাওয়ার পর সরকার সমর্থিতদের মনে আরো ভয় তৈরি হয় এবং মানুষ পালানোর জন্য হুড়োহুড়ি করে রাস্তায় ভিড় বাড়ায়।
বিমানবন্দরের রাস্তায় গাড়ির ভিড় জমে। যে যেভাবে পারে এয়ারপোর্টে চলে আসতে থাকে। এয়ারপোর্টে অনেক মানুষের ভিড় করেন। কিছু দৃশ্য দেখা যায় মানুষ প্লেনের পাখা ধরেও যাত্রা করতে চায় এমন দৃশ্য ভাইরাল হয়। ক্যামেরায় ধরা পড়ে উড়ে যাওয়া প্লেন থেকে একজন পড়ে যান। এরপর সকল ফ্লাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়। অনেকের দেশ ত্যাগ করার ইচ্ছে থাকলেও কোনো সুযোগ ছিল না।

তালেবান শাসন আসলে কেমন?

এদিকে অনেকের মধ্যেই সন্দেহ তৈরি হয়েছে তালেবানদের ২য় বার ক্ষমতায় আসার পরে দেশের শাসন কেমন হতে পারে।
২০০১ সালে আমেরিকার আক্রমণের আগে তালেবানরা ৫ বছর আফগানিস্তান শাসন করেছিল।
তখন তালেবানরা ইসলামি আইনের কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে। এর মধ্যে রয়েছে-

১. নারীরা পুরুষ সঙ্গী ছাড়া ঘর থেকে বের হতে পারবেন না।
২. বোরকা ছাড়া কেউ ঘরের বাইরে যেতে পারবেন না
৩. কোনো ধরনের নোংরা গান প্রচার করা যাবে না।
৪. বৈবাহিক সম্পর্ক ছাড়া কেউ যৌন সঙ্গম করলে উভয়কে ১০০ ঘা চাবুক মারা।
৫. কোনো বিবাহিত মানুষ অন্যের সাথে যৌন সম্পর্ক করলে পাথর ছুড়ে মৃত্যু।
৬. কারো চুরির অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার হাত কাটা।
৭. পুরুষদের দাড়ি রাখা বাধ্যতামূলক করা ইত্যাদি

আফগানিস্তান কি আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে?

এখনই বিষয়টি নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তবে তালেবানরা এবার আশ্বস্ত করে বলছে, এখনকার তালেবান ২০ আগের সেই তালেবান নয়। তারা এখন অনেক পরিপক্ব। তারা বলছে, মহিলাদের অধিকার নিশ্চিত করা হবে।
তালেবান মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ইসলামি শরিয়া অনুযায়ী মহিলাদের অধিকার নিশ্চিত করা হবে।
কিন্তু আফগানিস্তানের অনেক মানুষ এখনও সন্দিহান কী হতে চলছে?

আফগানিস্তান শিক্ষার নির্বাহী পরিচালক পাশান্তা দুরানি বলেন, তালেবানরা আমাদের মহিলা হিসেবে দেখে না। আমাদের দেশের ২য় শ্রেণীর নাগরিক মনে করা হয়। তারা আামদের পণ্য হিসাবে দেখেন। তাদের প্রত্যাশিত সম্পদ মনে করেন। মহিলাদের কোনো কথার গুরুত্ব দেওয়া হয় না।

বর্তমানে মানুষের জীবন পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়েছে। দেশে হঠাৎ সকল বিভাগে পরিবর্তনে কোন নিয়ম মেনে চলছে না কিছু।
খাবারের দাম অনেক বেড়েছে। সাধারণ মানুষ অনুদান পাচ্ছে না। মানুষ টাকা তুলতে ব্যাংকে ভিড় জমাচ্ছে। কিন্তু সেখানেও সমস্যা দেখা দিয়েছে।

অনেক মানুষ খুবই চিন্তিত, তাদের সাথে কী হবে?
এখন দেখার বিষয় যে, তালেবান সরকার কী করে?

দোহার আন্তর্জাতিক আলোচনা সভায় তালেবান বছরের পর বছর আলোচনা করে কিছু কিছু সমাধান করেছে। এখন আন্তর্জাতিক মহল তালেবানদের সরকার গঠনে উৎসাহ প্রদান করছে। এবং আফগান সমাজব্যবস্থা মেনেই সরকার গঠন করার কথা রয়েছে। তালেবানরা আন্তর্জাতিক বৈধতার জন্য হয়তো কিছুটা কঠোরতা থেকে সরে আসবে।

বর্তমানে তালেবানরা আফগানিস্তানের রাষ্ট্রপতির ভবনে অবস্থান করছেন, কেউ কেউ রাস্তায় টহল দিচ্ছেন।

তালেবানদের ইতিহাস জানতে চাইলে নিচের লিংকে ভিজিট করুন।

তালেবান কি ফিরছে আফগানিস্তানের মসনদে?

তালেবান নেতা : যাদের নেতৃত্বে ফের আফগানিস্তানের ক্ষমতায়

Scroll to Top