ইসরাইলি গুপ্তচর মুস্তারিবিন : টার্গেট কিলিংয়ের গোপন মিশন

273

মুসতারিবিন উচুঁমানের প্রশিক্ষিত ইসরাইলি সেনাদের মাধ্যমে গঠিত। এলিট স্পেশাল ফোর্সের ছদ্মবেশী গুপ্তচরদের শক্তিশালী ইউনিট। এই বাহিনীর জন্য বাছাই করা হয় চেহারা ও শারীরিক গঠন ফিলিস্তিনিদের মতো এমন লোকদেরই। ছদ্মবেশে সাধারণ ফিলিস্তিনি সেজে পশ্চিম তীরে কাজ করে। এদেরকে কঠোর প্রশিক্ষণ দিয়ে আরবি ভাষা ও সংস্কৃতিতে পারদর্শী করে গড়ে তোলা হয়।

এরা ফিলিস্তিনি লোকদের মতোই আরবি উচ্চারণে সুন্দর করে কথা বলে, মনে হয় তা তাদের মাতৃভাষা। অনেক নিখুঁতভাবে আরব রীতিনীতি অনুসরণ করে, আরব কায়দায় ফিলিস্তিনিদের মতোই পোশাক পরিধান করে ও আরব আচরণ আয়ত্ত করে। তাদের আচার-আচরণ, মাঙ্কি টুপি কিংবা আরবীয় পাগড়িতে মুখ ঢাকা দেখে কারো বিন্দুমাত্রও সন্দেহ হয় না যে তারা ফিলিস্তিনি নয়।

ফিলিস্তিনের বাইরেও সক্রিয় মুসতারিবিন

তবে মুসতারিবিনের কাজ শুধু ফিলিস্তিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ইয়েমেন, তিউনিসিয়ার মতো অন্য অনেক আরব দেশেও আরবদের ছদ্মবেশেও সক্রিয় ইসরাইলি এজেন্টদের গোপন এই চক্র। এরা মূলত যখন যে দেশে কাজ করে, কাজ শুরুর আগেই সেই দেশের উচ্চারণ ভঙ্গি, স্থানীয় ভাষা, সংস্কৃতির ওপর কঠোর প্রশিক্ষণ নেয়।

মুসতারিবিনের প্রশিক্ষণ

রোজা, নামাজসহ অনান্য ইবাদতগুলো পালনেও মুসলিমদের মতো অভ্যস্ত করে তোলা হয়। বাড়তি সতর্কতার জন্য প্রয়োজনে মেকাপ ও পরচুলাও ব্যবহার করে তারা। এসব আয়ত্ব করাতে চার থেকে ছয় মাস টানা প্রশিক্ষণ চলে। এসব প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের ভিড়ে মিশে যাওয়া, আত্মরক্ষা করা বিভিন্ন কৌশলে পারদর্শী করা ও অস্ত্র চালানোসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ তো রয়েছেই। সব মিলে ১৫ মাস থেকে দেড় বছরের প্রশিক্ষণ শেষে সম্পূর্ণরুপে মিশনে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে প্রস্তুত করা হয় এক একজন মুস্তারিবিনকে।

ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীকে মুসতারিবিন সদস্যদের গ্রেফতার, পাশে ইসরাইলি সৈন্য-
ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীকে মুসতারিবিন সদস্যদের গ্রেফতার, পাশে ইসরাইলি সৈন্য

টার্গেট কিলিংয়ের গোপন মিশন

নিষ্ঠুরতার জন্য পরিচিত ইসরাইলি গুপ্তচর বাহিনীর মুসতারিবিন ইউনিটের সদস্যরা এবার ব্যাপকভাবে টার্গেট কিলিংয়ের গোপন মিশন চালাচ্ছে। টার্গেট করা হচ্ছে মূলত ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনের সদস্যদের। এরপর উঠিয়ে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে। রাস্তা থেকে অপহরণ করছে। বাড়ি থেকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কর্মস্থল থেকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। নেয়ার পর কখনো লাশ পাওয়া যাচ্ছে, কখনো খোঁজই মিলছে না আবার কখনো কারাগারে আটক করা হচ্ছে।

যেভাবে অভিযান চালায় মুসতারিবিন

এরা ফিলিস্তিনিদের মধ্যে খুবই চাতুরতার সাথে অভিযান চালায়। প্রথমে ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীদের চিহ্নিত করে। তারপর যাকে একটু বেশি চৌকস মনে হয় তাকে টার্গেট করে। তারপর সুযোগের অপেক্ষায় উৎপেতে থাকে। বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালাতে থাকে। একটি কৌশল ব্যর্থ হলে নতুন আরেকটি কৌশল নিয়ে সামনে এগোয়। যেকোনো মূল্যে যেকোনো উপায়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। তাদের হাত থেকে শিশুরাও নিরাপদ নয়। এর কারণে সবসময় ফিলিস্তিনিদের মধ্যে আতঙ্ক ও উদ্বেগ বিরাজ করছে।

ইসরাইলি সেনাবাহিনী মুস্তারিবিনের গুপ্তচরদেরকে যাকে ইচ্ছা তাকে আটক করার ক্ষমতা দিয়েছে । মুসতারিবিনের সদস্যদের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সরঞ্জাম সররাহ করে ইসরাইলি সেনাবাহিনী। ফলে এরা কোনো দ্বিধা সংকোচ ছাড়াই ফিলিস্তিনিদের মধ্যে গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে।

এরা এতটাই ধুরন্ধর যে, তারা উচ্চস্বরে ইসরাইলবিরোধী স্লোগান দেয়, ইসরাইলবিরোধী মিছিলে অংশ নেয়, কখনো ইসরাইলি সেনাবাহিনীর উদ্দেশে পাথর ছুড়ে প্রতিবাদ করতে থাকে। ফিলিস্তিনিদের বেশভূষায় বিক্ষোভ করতে করতে সামনে এগোতে থাকলেও ইসরাইলি সেনাবাহিনীর কাছাকাছি পৌঁছতেই হঠাৎ জাপটে ধরে আশপাশের টার্গেটকৃত বিক্ষোভকারীদের। বাধা পেলেই জামার ভেতর থেকে লুকানো পিস্তল বের করে গুলি ছুড়তে শুরু করে।

এমন আচমকা পরিস্থিতিতে ছত্রভঙ্গ বিক্ষোভকারীদের ইসরাইলি সেনারা ছুটে এসে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় টার্গেটকৃতকে। অনেকদিন ধরেই ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীদের গ্রেফতার করতে এমন একদল গুপ্তচর কাজে লাগাচ্ছে ইসরাইল। সেনাবাহিনীর অধীনে কঠোর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এদের গড়ে তোলা হয়।

সম্ভাবনাময়ী নেতৃত্বকে টার্গেট  করে মুসতারিবিন

মুস্তারিবিনের গুপ্তচররা টার্গেটকৃত এলাকায় গণমানুষের সাথে মিশে যায়। বিভিন্ন ধরনের কাজ করে। বিভিন্ন জনের সাথে সম্পর্ক করে। এসব পরিচয়-যোগাযোগ-সম্পর্কের মূল উদ্দেশ্যই থাকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা এবং ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হয়ে উঠতে পারে এমন সম্ভাবনাময় ফিলিস্তিনিদের গ্রেফতার করা। এরা ইসরাইলের বিরুদ্ধে যায় এমন যেকোনো কার্যক্রম প্রতিহত করতে যেকোনো মাত্রার নৃশংস কার্যক্রম পরিচালনা করতে দ্বিধা করে না। অপহরণ, খুন, গুম, প্রতারণা ও মিথ্যাচারের মতো অপরাধ করাই এদের কাজ।

কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা ও ব্যাপক সুযোগসুবিধা দেয় ইসরাইল

১৯৪২ সালে মুস্তারিবিন বাহিনী গঠনের পর থেকেই এই গ্রুপটির কাজের বিষয়ে অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে ইসরাইল। ইসরাইলি সেনাবাহিনী গঠিত হওয়ার পর এ গ্রুপটি বিলুপ্ত করা হয়, পরে আবার ভিন্ন আঙ্গিকে গড়ে তোলা হয় তাদের।

গোপনীয় এই গ্রুপটিতে যারা ইসরাইলি চর হিসেবে কাজ করে, সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখে তাদেরকে বিভিন্নভাবে স্বীকৃতি বা সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। মুস্তারিবেনদের গ্রুপ বিক্ষোভে প্রতিবাদকারীদের মাঝে মিশে ফিলিস্তিনিকে আটক করে, গুলি করে, হত্যা করে, পঙ্গু করে দেয়। বিক্ষোভকারীদের মাঝে থেকেই, গায়ে লাল জামা পরেই, রুমাল দিয়ে মুখ ঢেকেই তথা বিক্ষোভকারী সেজে বিক্ষোভকারীদের একেবারে সামনের সারিতে থেকেই তারা বিক্ষোভকারীদের চরম ক্ষতি করে। নিজেরাও বিক্ষোভকারীদের মতোই স্লোগান দিতে দিতেই হঠাৎ করে সাউন্ড গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায়, পিস্তল বের করে ফাঁকা গুলি ছুড়তে শুরু করে, জাপটে ধরে মাটিতে ফেলে দেয়। গুলি করলে অনেকে প্রাণ হারায়, অনেকে প্রাণে বেঁচে গেলেও পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যায়।

মুসতারিবিন : ইসরাইলি গুপ্তচর । ২০১৫ সালের ছবি।

যদি কোনো বিক্ষোভের মধ্যে মুস্তারেবিনের গুপ্তচররা থাকলে ফিলিস্তিনিরা সেনাদের ওপর পাথর ছুড়লেও সেনাবাহিনী কোনো জবাব দেয় না। যখনই বিক্ষোভে ইসরাইলি চর প্রবেশ করে তখন সেনারা গুলি, টিয়ার গ্যাস কিছুই ছোড়ে না।

সাম্প্রতিক সময়ে মুস্তারেবিনদের উপস্থিতির বিষয়ে অনেক সতর্ক হয়েছে ফিলিস্তিনিরা। বিক্ষোভকালে আশপাশের লোকদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন তারা। নিজেদের মুস্তারিবিনদের থেকে আলাদা করতে তারা কোমরের কাছে প্যান্টের ভেতর শার্ট গুজে রাখে। কারণ, কোমরে অস্ত্র গোঁজা থাকলে কেউ এমন ইন করতে পারবে না। কখনো কখনো বিক্ষোভকারীদের পর্যবেক্ষণের জন্য একটি গ্রুপকে দায়িত্বও দেয়া হয়। যাদের দায়িত্ব হয় বিক্ষোভে সন্দেহজনক লোকদের উপস্থিতির ওপর চোখ রাখা।

আরো পড়ুন-

ফিলিস্তিনে ইসরাইলি গুপ্তবাহিনীর নিষ্ঠুরতা

সূত্র : আলজাজিরা, টিআরটি ওয়ার্ল্ড ও অন্যান্য