ব্যাপকভাবে আলোচিত ইব্রাহিম রাইসি ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম শনিবার সকালে তার জয়ের খবর প্রকাশ করে। ২০২১ সালের ৩ আগস্ট তার দায়িত্ব গ্রহণের কথা রয়েছে।
তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন পরাজিত প্রার্থীরা। গত শুক্রবার এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৫ কোটি ৯ লাখ ভোটারের মধ্যে এ নির্বাচনে ২ কোটি ৮ লাখ ভোটার তাদের ভোট দেন।
তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ডের খবরে বলা হয়, রাইসি ৬২ ভাগ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি ১ কোটি ৭ লাখ ৮০ হাজার ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী রেজায়ী পেয়েছেন ৩৩ লাখ ভোট। আর আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী হিম্মতি পেয়েছেন মাত্র ২৪ লাখ ভোট।
এর আগে বিভিন্ন জরিপে ইব্রাহিম রাইসিই এগিয়ে ছিলেন। কারণ আহমেদিনিজাদের মতো শক্তিশালী প্রার্থীরা আগেই প্রার্থী তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন।
যার ফলে ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত হওয়া ইব্রাহিম রাইসিই বিশ্ব মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে আলোচিত হন।
রাইসির মতাদর্শ অতি-রক্ষণশীল। তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এবং অতীতে রাজনৈতিক বন্দীদের মৃত্যুদণ্ডের সঙ্গেও তার সম্পর্ক রয়েছে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির পর প্রেসিডেন্ট দেশটির দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি।
ইরানের আভ্যন্তরীণ নীতিমালা ও পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে প্রেসিডেন্টের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। তবে সুপ্রিম নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি রাষ্ট্রীয় বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন।
কে এই ইব্রাহিম রাইসি?
পুরো নাম সৈয়দ ইব্রাহিম রাইসুল সাদাতি। পরিচিতি ইব্রাহিম রাইসি নামে। বর্তমান ইরানের প্রধান বিচারপতি। ৬০ বছর বয়সী রাইসি বর্তমানে দেশটির ক্ষমতাসীন সরকারের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম। এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচনী দৌড়ে শামিল হয়েছেন তিনি। এর আগে ২০১৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও একবার ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন, ওই সময় তিনি হাসান রুহানির কাছে পরাজিত হন।
ইরানের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক নেতা খামেনি এবং রাইসির জন্ম একই স্থানে, দেশটির উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় শহর মাশহাদে। খামেনির মতো না হলেও দেশটির সংখ্যাগুরু শিয়া সম্প্রদায়ের কট্টরপন্থিমহলে তার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপক।
খামেনির মতো রাইসিরও দাবি, বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদ (সঃ)-এর বংশধর তিনি। বিশ্বনবীর রক্তসম্পর্কিত উত্তরাধিকার হওয়ার কারণে সবসময় কালো রঙের পাগড়ি পরেন তিনি।
তবে ইরানের গণতন্ত্রপন্থী বলয়ে তার জনপ্রিয়তা বেশ কম। কারণ, আশির দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় দেশটিতে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন গণতন্ত্রপন্থীরা, যারা ক্ষমতাসীন ইসলামী কট্টরপন্থী সরকারের বিরোধী।
যুদ্ধ শেষে রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতার কারণে শত শত গণতন্ত্রপন্থীকে গ্রেফতার করা হয় এবং তেহরানের রেভ্যুলুশনারি আদালত সংক্ষিপ্ত বিচারকাজের পরই তাদের অধিকাংশকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়। সে সময় রেভ্যুলুশনারি আদালতের প্রধান বিচারক ছিলেন রাইসি।
ওই বিচার প্রক্রিয়ার পরই খামেনির আস্থাভাজন হিসেবে হিসেবে উত্থান ঘটে তার।
ইব্রাহিম রাইসির কর্ম জীবন
ষাট বছর বয়সী ইব্রাহিম রাইসি তার কর্মজীবনের বেশিরভাগ সময় সরকারি কৌঁসুলি হিসেবে কাজ করেছেন।
১৯৮১ সালে, তিনি কারাজের আইনজীবী নিযুক্ত হন। পরে, তিনি হামদানের প্রসিকিউটর হিসাবেও নিযুক্ত হন এবং উভয় পদে একসাথে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ৩০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে দুটি শহরে একই সাথে সক্রিয় ছিলেন। চার মাস পর তিনি হামাদান প্রদেশের প্রসিকিউটর নিযুক্ত হন।
১৯৮৫ সালে তিনি তেহরানের ডেপুটি প্রসিকিউটর নিযুক্ত হন এবং রাজধানীতে চলে যান। তিন বছর পরে ১৯৮৮ সালের গোড়ার দিকে, তিনি আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নজরে আসেন। তাকে খোমেনির কার্যালয়ের বিশেষ শাখায় নিয়োগ দেয়া হয়।
খোমেনীর মৃত্যুর পর আলী খামেনি নতুন সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচিত হন। তখন প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ইয়াজদী রাইসিকে তেহরান প্রসিকিউটর হিসাবে নিয়োগ দেন। ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত তিনি পাঁচ বছর এই অফিসে ছিলেন। ১৯৯৪ সালে তিনি সাধারণ পরিদর্শন অফিসের প্রধান হিসাবে নিযুক্ত হন।
২০০৪ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত রইসি ইরানের প্রথম উপ-প্রধান প্রধান বিচারপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
পরে তিনি ২০১৪ সালে ইরানের অ্যাটর্নি-জেনারেল হিসাবে নিযুক্ত হন। তিনি ২০১৬ অবধি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
২০১৬ সালে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্থা আস্তান কুদস রাজাভি ফাউন্ডেশনের প্রধান হিসেবে রাইসিকে নিয়োগ দেন খামেনি। ইরানের শিয়া মুসলিমদের কাছে পবিত্র তীর্থ বলে বিবেচিত ইমাম রেজার মাজারের রক্ষনাবেক্ষণের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দাতব্য কার্যক্রম ও দেশের অধিকাংশ কোম্পানি পরিচালনাও করে থাকে এই ফাউন্ডেশন।
তিন বছর মোটামুটি সফলভাবে আস্তান কুদস রাজাভি ফাউন্ডেনের নেতৃত্ব দেওয়ার পর ২০১৯ সালে তাকে বিচার বিভাগের প্রধান পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এ পদে থাকার সময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ায় দেশের অভ্যন্তরে জনপ্রিয়তা কিছুটা বাড়ে তার।
ইব্রাহিম রাইসির রাজনৈতিক দর্শন
নিজেকে ‘দুর্নীতি, অদক্ষতা ও অভিজাতদের’ ঘোর বিরোধী হিসেবে প্রকাশ করা রাইসি রাজনৈতিক দিক থেকে শিয়া ইসলামী কট্টরপন্থার সমর্থক। দেশের গণতন্ত্রপন্থীদের পাশাপাশি তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্য দেশগুলোরও কঠোর সমালোচক।
তবে সম্প্রতি নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের অর্থনীতি প্রায় পঙ্গু হয়ে যাওয়ার উপক্রম হওয়ায় বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যের বিষয়ে সুর নরম করেছেন তিনি।
ইরানের রাজনীতি ও আর্থসামাজিক পরিস্থিতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আলী রেজা ইশরাঘি দেশটির সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রসঙ্গে ‘ফরেন রিলেশনস’ সাময়িকীতে লিখেছেন, ‘এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ইরানের রাজনীতিতে নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে এবং দেশটির গণতন্ত্রপন্থিদের সঙ্গে রক্ষণশীলদের দ্বন্দ্ব নতুনমাত্রা পাবে।’
ইব্রাহিম রাইসির ব্যক্তিগত জীবন
রাইসির সাথে জুমার নামাজের ইমাম আহমদ আলমোলহোদা কন্যা জামিলিহ আলমোলহোদার সাথে বিয়ে হয়। তিনি তেহরানের শহীদ বেহেস্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের সভাপতি। এই দম্পতির দুটি কন্যা রয়েছে।
ইরান ও সারা বিশ্বের জন্য তার এই বিজয়ের অর্থ কী
বিবিসির ফার্সি বিভাগের কাসরা নাজি বলছেন, রাইসির অধীনে কট্টরপন্থীরা ইসলামি অনুশাসন মেনে সরকার পরিচালনার ব্যাপারে আরো কঠোর হবেন। যার অর্থ সামাজিক কার্যক্রমের ওপর আরো বেশি নিয়ন্ত্রণ, নারীদের কর্মসংস্থান ও স্বাধীনতা কমে যাওয়া এবং সংবাদ মাধ্যমসহ সোশাল মিডিয়ার ওপর আরো বেশি নিয়ন্ত্রণ আরোপ।
কট্টরপন্থীরা পশ্চিমাদের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করলেও রাইসি এবং সর্বোচ্চ নেতা খামেনি তারা উভয়েই পরমাণু কর্মসূচির বিষয়ে আন্তর্জাতিক চুক্তিতে ফিরে যেতে আগ্রহী বলে ধারণা করা হয়।
২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত ওই চুক্তিতে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি সীমিত করার শর্তে দেশটির ওপর থেকে কিছু নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছিল।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০১৮ সালে এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেয় এবং ইরানের ওপর বেশ কিছু বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
নিষেধাজ্ঞার কারণে সাধারণ ইরানিরা অর্থনৈতিক দুর্দশায় পড়েছে যার কারণে জনগণের মনে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর ইরান তাদের পরমাণু কর্মসূচি পুনরায় চালু করে।
চুক্তিটি পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে ভিয়েনায় আলোচনা চলছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেনও চুক্তিটিকে বাঁচিয়ে তুলতে আগ্রহী। কিন্তু উভয়পক্ষই বলছে যে অন্যপক্ষকে প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে।
তথ্যসূত্র :