ইয়েমেন সঙ্কটে ব্রাদারহুডের কাছাকাছি সৌদি আরব

চার বছর আগে আরব বসন্ত শুরু হওয়ার পর থেকেই সৌদি আরব দুটি ফ্রন্টে লড়াই শুরু করে। এর দিকে রয়েছে তার প্রতিদ্বন্দ্বী শিয়া ইরান আর অন্যদিকে মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতৃত্বাধীন সুন্নী ইসলামপন্থীরা। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে এদের উত্থানে সৌদি সরকারের বৈধতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে।

তবে গত সপ্তাহে সৌদি বাদশা সালমান ইরান সমর্থিত হুথি বাহিনীর বিরুদ্ধে অপ্রত্যাশিতভাবে যে বৃহত্তর সুন্নী জোট গঠন করতে সক্ষম হয়েছেন তাতে আগের সেই অবস্থার অবসান হয়েছে।

নতুন এই পরিস্থিতিতে ইরানি সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্রাদারহুড ইস্যুতে সৌদি আরবের আঞ্চলিক যুদ্ধে পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে ধারণা করা হচ্ছে যে ব্রাদারহুড এতোটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে মনে করা হচ্ছে তারা সৌদি রাজতন্ত্র এবং তার সহযোগীদের জন্য এখন কোনো বিপদের কারণ হবে না।

রিয়াদের এই অবস্থান পরিবর্তনের আরো একটি কারণ হলো তার অস্তিত্ব সঙ্কটের আশঙ্কা। রিয়াদের আশঙ্কা তাদের নিজ সংখ্যালঘু শিয়া সম্প্রদায়ই ইরানের সহায়তায় বিক্ষোভের সূচনা করতে পারে।

‘সৌদির জন্য ইয়েমেন ইস্যু অত্যন্ত কেন্দ্রীয়। তারা আশঙ্কা করছে, ইয়েমেনে যদি ইরানের পররাষ্ট্রনীতির অনুকূল একটি সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় তবে সৌদি আরবের অভ্যন্তরেই শিয়াদের কণ্ঠ আরো জোরালো হবে,’ বলছিলেন কাতার ইউনিভার্সিটির গালফ স্টাডিজ প্রোগ্রামের সমন্বয়ক খালিদ আলমেজাইনি।

‘হুথিদের সামরিক সামর্থ্য এবং অস্ত্রশস্ত্র আছে এবং তারা বড় একটা হুমকি। মুসলিম ব্রাদারহুড (এখন) তুলনামূলকভাবে দুর্বল এবং যে কোনো স্থানের ব্রাদারহুডের নিয়ন্ত্রণে সৌদি এখন ভালো অবস্থানে আছে,’ যোগ করেন খালিদ।

তবে সৌদির এই অবস্থান পরিবর্তনের মানে এই নয় যে সাবেক মিশরীয় সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি ২০১৩ সালে ব্রাদারহুড নেতা মোহাম্মদ মুরসিকে উৎখাত করার পর মধ্যপ্রাচ্যের সুন্নী শক্তির মধ্যে রাজনৈতিক ইসলাম নিয়ে যে বিভাজন তৈরি হয়েছে তার অবসান হলো।

তারপর থেকেই সৌদি আরব, মিশর এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ব্রাদারহুডকে আল কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটের মতই ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’ হিসেবে চিহ্নিত করে আসছে, যদিও দলটি অহিংস ও নির্বাচনী গণতন্ত্রের পক্ষেই সোচ্চার।

ব্রাদারহুড-বিরোধী ত্রাতার অবস্থান থেকে মাঝামাঝি অবস্থান নেয়ায় সৌদি আরব ইয়েমেন অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ সব সুন্নী দেশকেই কাছে টানতে পেরেছে। এর মধ্যে মুরসির প্রধান সমর্থক তুরস্ক যেমন রয়েছে তেমিন রয়েছে মিশরের প্রেসিডেন্ট সিসির সমালোচক কাতার। আছে ইসলামপন্থীদের ঘোর বিরোধী আরব আমিরাতও।

যদিও তুরস্ক সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়নি তবে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েব এরদোগান সৌদি অভিযানে সমর্থন দিয়েছেন এবং সম্প্রতি ইরানের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছেন। এর আগে এমনটা দেখা যেত না। বিপরীতে উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র দেশ ওমান, যেটি সুন্নী শাসিত নয়, ইয়েমেনে হস্তক্ষেপ থেকে দূরে রয়েছে।

‘সুন্নী গোষ্ঠীগুলো এখন ইরান সম্পর্কে বেশি উদ্বিগ্ন এবং তারা কাছাকাছি এসেছে,’ বলছিলেন ব্রাদারহুডের ওপর লেখা একটি বইয়ের গ্রন্থকার এবং ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশনের গবেষক শাদি হামিদ।

সৌদি আরবের কর্মকর্তারা প্রায়ই বলছেন যে গত জানুয়ারিতে প্রয়াত বাদশা আবদুল্লাহর নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে চান বাদশা সালমান। তবে ব্রাদারহুড ইস্যুতে তাদের মধ্যে পার্থক্য দিনদিনই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

‘গত কয়েকবছর সৌদি কর্মকর্তারা এবং গণমাধ্যমে মুসলিম ব্রাদারহুড এবং আইসিস (ইসলামিক স্টেট) ছিল প্রায় অভিন্ন। কিন্তু এখন সেখানে নিশ্চিতই পরিবর্তন আসছে,’ বলছিলেন সৌদি বিশেষজ্ঞ ফাহাদ নাজের

সৌদি সংবাদপত্র আল আলজাজিরাকে গত ফেব্রুয়ারিতে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৌদ আল ফয়সাল এমন ইঙ্গিতই দিয়েছিলেন।

সেখানে তিনি বলেন, ‘মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে আমাদের কোনো সমস্যা নেই।’

তিনি বলেছিলেন, সৌদি আরব শুধু সংগঠনটির সাথে জড়িত ক্ষুদ্র একটি অংশের বিরোধীতা করছে।

এদিকে মিশরে ভয়াবহ নিপীড়ন এবং এ অঞ্চলের অন্যত্র বেকায়দায় থাকা ব্রাদারহুডও এ সুযোগ নেয়ার জন্য আগ্রহী। গত সপ্তাহে ইয়েমেনে সৌদি বিমান হামলা শুরুর পর থেকেই মোটাদাগে ব্রাদারহুড নেতারা রিয়াদের অভিযানে সমর্থন জানাচ্ছেন।

ইয়েমেনে সৌদি অভিযানের প্রতি সতর্ক সমর্থন জানিয়েছেন নির্বাসিত মুসলিম ব্রাদারহুড নেতা ও মুরসি শাসনামলের মন্ত্রী আমর দারাগ।

তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করি সৌদি আরবের নেতৃত্বে সম্প্রতি যে সামরিক জোট গঠিত হয়েছে তা দেশটির নতুন প্রশাসনের নতুন অবস্থানের প্রতিফলন যা ইয়েমেন এবং অন্যান্য স্থানের জনগণের ইচ্ছাকে সমর্থন করবে।’

‘ইয়েমেনে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যে কোনো পদক্ষেপের প্রতি আমার সমর্থন থাকবে,’ যোগ করেন দারাগ।

বোঝাই যাচ্ছে যে সৌদি নেতৃত্বাধীন এই সামরিক জোট স্পষ্টতই সাম্প্রদায়িক (সুন্নী জোট)।

তবে এর আগে ইয়েমেনে বহু যুগ শাসন করেছে হুথি, সাবেক স্বৈরশাসক আলী আবদুল্লাহ সালেহ এবং জায়েদি গোত্রের রাজকীয় পরিবার। তারা সবাই ছিলেন সুন্নী ঘেঁষা এবং সৌদি আরব তাদের ব্যাপারে কোনো বিপরীত অবস্থান নেয়নি। এমনকি ষাটের দশকে মিশরীয় দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে জায়েদী বিদ্রোহীদের লড়াইয়ে সমর্থন দিয়েছে সৌদি আরব।

ইয়েমেনের এই সম্প্রদায়িক খেলায় সৌদি আরব আবারো মুসলিম ব্রাদারহুডের পাশে দাঁড়াতে পারে।

ইয়েমেনি ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট আবদো রাব্বু মনসুর হাদি সৌদি আরবে আশ্রয় নিয়েছেন। নিজ দেশে তার ক্ষমতার ভিত্তি বলতে তেমন কিছু অবশিষ্ট নেই।

এ অবস্থায় ইয়েমেন সৌদি আরবের টেকসই সুন্নী সহযোগী হতে পারে ব্রাদারহুডের ইয়েমেনী শাখা ইসলাহ। এক সময় ইসলাহ রিয়াদের ঘনিষ্ঠ ছিল।

ইয়েমেনে হুথিদের বিরুদ্ধে সংঘাতের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে ইসলাহর। সাবেক প্রেসিডেন্ট হাদি ও সালেহর আমলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ইসলাহ। হুথিরা দেশের বেশিরভাগ এলাকা দখল করে নেয়ায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইসলাহ।

‘সৌদিদের সত্যিকার অর্থেই ইয়েমেনের স্থানীয়দের সাথে কাজ করা দরকার,’ বলছিলেন আবু ধাবির রাজনৈতিক বিশ্লেষক হাসান হাসান।

‘নতুন সৌদি প্রশাসনে এই বোধোদয় হয়েছে যে মুসলিম ব্রাদারহুড সঙ্গী হতে পারে- এবং এক্ষেত্রে ইসলাহই হবে প্রথম পরীক্ষা,’ বলছিলেন হাসান।

লেখক: ওয়াল স্ট্রীট জার্নালের সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবং ‘ফেইথ অ্যাট ওয়ার’ এবং ‘সিজ অব মক্কা’ গ্রন্থের লেখক

Scroll to Top