কয়েক দিন আগে শ্রীনগরে তিনজন কাশ্মিরি পণ্ডিতের মর্মান্তিক মৃত্যু আরো একবার ওই কাশ্মিরি অমুসলিমদের টিকে থাকা নিয়ে প্রশ্ন জন্ম দিলো, যারা জানমালের সর্বাত্মক হুমকি সত্ত্বেও এখনো উপত্যকায় বসবাস করছেন।
গত ১২ অক্টোবর বিখ্যাত রসায়নবিদ মাখন লালের হত্যাকাণ্ডের পর ১৪ অক্টোবর উগ্রবাদীরা একটি সরকারি স্কুলের প্রিন্সিপাল সুপিন্দার কৌর ও স্কুলশিক্ষক দীপক চান্দকে নির্মমভাবে হত্যা করে। করাচি থেকে পরিচালিত সন্ত্রাসী সংগঠন টিআরএফ (The Resistance Front) এ হামলার দায় স্বীকার করেছে। মাখন লালের হত্যার দায় স্বীকার করে লস্করে তাইয়্যেবা বলেছে, তারা আরএসএসের জন্য কাজ করতেন।
বলা হচ্ছে যে, সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত সুপিন্দার ভালো মনের মহিলা ছিলেন। তিনি তার অর্ধেক বেতনই দরিদ্র শিশুদের শিক্ষার পেছনে ব্যয় করতেন। তিনি এক মুসলিম এতিম শিশুকেও নিজের কাছে রেখে প্রতিপালন করতেন।
এ হত্যাকাণ্ডে নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে অল পার্টিস শিখ কো-অর্ডিনেশন কমিটির চেয়ারম্যান জগমোহন সিং রায়না বলেন, ‘এ হামলা উপত্যকায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘুর মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করার ষড়যন্ত্রের অংশ।’
কাশ্মিরের ইতিহাস আমাদের বলে যে, এখানে হিন্দু-মুসলমান বহু বছর ধরে এক সাথে মিলেমিশে বসবাস করে আসছে। উভয়ের সংস্কৃতি ও জীবনাচারই শুধু নয়, বরং ভাষা ও উচ্চারণ ভঙ্গিও এক। কাশ্মিরে পদে পদে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের নিদর্শন চোখে পড়ে।
পরিস্থিতি এত নাজুক হওয়া সত্ত্বেও আজো অমরনাথ যাত্রার সময় উপত্যকার মুসলমানরাই ভক্তদের গুহা পর্যন্ত পৌঁছে দেন। বিনোদন-পর্যটনের জন্য কাশ্মিরে আগত লাখ লাখ পর্যটকও ডাল লেক ও গুলমার্গ ভ্রমণের জন্য স্থানীয় মুসলমানদের সহায়তা নিয়ে থাকেন এবং এটিই ওই মুসলমানদের রুটি রুজি উপার্জনের মাধ্যম। কিন্তু যখন থেকে উপত্যকায় বিদ্রোহের সূচনা হয়েছে, তখন থেকে পর্যটন প্রায় বন্ধ হয়েই গেছে এবং এখানকার হিন্দু-মুসলমানের ভ্রাতৃত্ববন্ধনও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
অথচ উপত্যকার শান্তিপ্রিয় মুসলমানরা কখনো চায়নি, তাদের আশপাশে বছরের পর বছর ধরে বাস করা কাশ্মিরি পণ্ডিতগণ তাদের থেকে আলাদা হোক। কেননা তারা তাদেরই অস্তিত্বের একটি আবশ্যিক অংশ। হিন্দুদের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার পর স্থানীয় মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
হিন্দি দৈনিক ‘ভাস্কর’-এ গত ১৩ অক্টোবরে প্রকাশিত বিস্তারিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ‘কাশ্মিরে বসবাসরত অমুসলিম অধিবাসীরা অবশ্যই সন্ত্রস্ত। তবে আশার এক আলো দেখা যাচ্ছে যে, কাশ্মিরের অমুসলিমদের তাদের নিরাপত্তার ভরসা দিতে স্থানে স্থানে মুসলমানরাই এগিয়ে আসছেন। তারা বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছেন এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ করছেন। এমনকি সন্ত্রাসের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের ঘরে গিয়ে তাদের অবশিষ্টদের দুঃখ ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন।’
উল্লেখ্য, শ্রীনগরের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ মসজিদ থেকে অমুসলিমদের নিরাপত্তার জন্য মুসলমানদের এগিয়ে আসতে আহ্বান জানানো হয়। উল্লিখিত মসজিদ দু’টির ইমাম জুমার নামাজের খুতবার পর বিশেষভাবে শ্রীনগরে অমুসলিম প্রতিবেশীদের নিরাপত্তা প্রদান এবং কাশ্মিরি পণ্ডিতদের কাছে বসতি স্থানান্তর না করার জন্য আবেগময় আবেদন জানান। এ ধারাবাহিকতায় লালচকে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভে বিভিন্ন এলাকার মুসলমানরা অংশ নেন। এতে সরকারি চাকরিজীবী, খেলোয়াড়, প্রবীণ নাগরিক ও অন্যরা শরিক হন। সবাই নিরপরাধ ব্যক্তিদের হত্যার তীব্র নিন্দা এবং হত্যার ঘটনাগুলোকে সন্ত্রাসবাদ দ্বারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করেন।
বিক্ষোভকারীরা সবাই অমুসলিমদের কাছে নিবেদন করেন যে, তারা উপত্যকা থেকে অন্যত্র চলে গিয়ে সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যকে যেন সফল না করেন। কাশ্মিরের সরকারি কর্মজীবীদের সবচেয়ে বড় সংগঠনের একটি প্রতিনিধিদল কাশ্মিরি পণ্ডিতদের এলাকায় গিয়ে তাদের সান্ত্বনা দিয়েছে।
কমিটির প্রধান রফিক রাঠোরের বক্তব্য, ‘হত্যার এ ঘটনাগুলো আমাদের ঐতিহ্যবাহী রীতিনীতি বিরুদ্ধ। কাশ্মিরি পণ্ডিত ও মুসলমান যুগ যুগ ধরে একসাথে মিলেমিশে বসবাস করে আসছেন। আমাদের ঐতিহ্যবাহী বন্ধন ও রীতিনীতি টিকে থাকবে। আমরা তাকে কোনো উগ্রপন্থীর অপতৎপরতার শিকার হতে দেবো না।’
বারামুলাতে কাশ্মিরি পণ্ডিতদের সাথে দেখা করে ওই প্রতিনিধিদল বলে, ‘এই দুঃসময়ে আমাদের মুসলমানদের ঘর ও হৃদয় আপনাদের জন্য খোলা রয়েছে।’ কাশ্মিরি পণ্ডিতদের জন্য স্থানীয় মুসলমানদের এই আবেগ প্রশংসার যোগ্য।
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, কাশ্মিরি পণ্ডিতদের উপত্যকা থেকে চলে যাওয়ার পেছনে যেখানে পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতা দায়ী, সেখানে রাজনীতিও কিছুটা দায়ী। সবাই জানেন, নব্বইয়ের দশকে যখন জগমোহন রাজ্যের গভর্নর ছিলেন এবং সেখানে কোনো নির্বাচিত সরকার ছিল না, তখন তিনি উপত্যকা থেকে কাশ্মিরি পণ্ডিতদের চলে যাওয়ার (স্থানান্তরের) পথ সুগম করেছিলেন।
জগমোহনের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময়কাল মারাত্মক সমালোচনায় ভরপুর। এমনকি এ কথাও বলা হয় যে, তিনি একটি রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডার মাধ্যমে উপত্যকায় হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধির কাজ করেন যার খেসারত দিতে হয়েছে কাশ্মিরি পণ্ডিত ও মুসলমান উভয়কেই। আজ উপত্যকায় উভয়ের মধ্যে যে দূরত্ব দেখা যায়, তা মূলত জগমোহনের সময়েরই ফসল।
এমন নয় যে, বিদ্রোহে প্রভাবিত হয়ে শুধু কাশ্মিরি পণ্ডিতরাই এলাকা ত্যাগে বাধ্য হচ্ছেন, বরং অসংখ্য কাশ্মিরি মুসলমানও শান্তি ও নিরাপত্তার সন্ধানে উপত্যকা থেকে চলে গেছেন। তারাও দেশ-বিদেশের বিভিন্ন এলাকায় অসহায় নিঃসঙ্গ জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছেন।
কাশ্মিরের পরিস্থিতি এমনিতেই দীর্ঘ দিন ধরে খারাপ। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড রাজ্যের শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে। মোদি সরকার কাশ্মিরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল, বাস্তবে তার কোনো নিদর্শন চোখে পড়ছে না। মোদি লৌহ থাবায় কাশ্মিরের পরিস্থিতি শান্ত করতে চান, অথচ কাশ্মির সমস্যার সমাধান বাজপেয়ির কথা মতে একমাত্র ‘কাশ্মিরি জাতীয়তাবাদ, মানবতা ও গণতন্ত্র’ দ্বারাই হতে পারে। আফসোস, বর্তমান সরকার এ তিনটার কোনোটাতেই বিশ্বাসী নয়।
লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
(মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু নিউজ ১৭ অক্টোবর, ২০২১ হতে ভাষান্তর)