আনিসুর রহমান এরশাদ : আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও বাণিজ্যের অন্যতম বৃহৎ উৎস দক্ষিণ চীন সাগর ও পূর্ব চীন সাগর নিয়ে উত্তেজনা বাড়ছেই। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক চীন সাগরকে ঘিরেই পরবর্তী বিশ্বযুদ্ধ হবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। ওয়াশিংটন এ অঞ্চলের মিত্র রাষ্ট্রগুলোকে একজোট করে বেইজিংকে কৌশলগতভাবে বেকায়দায় ফেলতে সর্বোচ্চ চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
দু’টি সাগরই ভূরাজনীতির ক্ষেত্রে ও বিশ্ব অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নৌপথে বিশ্বের যত পণ্য পরিবহন করা হয় তার ৪০ শতাংশই হয় এই দু’টি সাগর দিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় তিনটি সমুদ্রবন্দরও অবস্থিত এই দু’টি সাগরকে ঘিরেই। মজুদ প্রাকৃতিক গ্যাস, খনিজ তেল ও বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ জাহাজ চলাচলের কারণে দক্ষিণ চীন সাগর ভূরাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এই সাগরকে কেন্দ্র করে চীনের সাথে বিভিন্ন দেশের জলসীমার বিরোধ রয়েছে।
চীন-জাপান ছাড়াও সাগরপাড়ের অন্য দেশগুলোর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা চুক্তি রয়েছে। যেমন তাইওয়ানের জনগণের ওপর কোনো ধরনের হুমকি এলে যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে রক্ষা করতে বাধ্য। এ ধরনের চুক্তি রয়েছে জাপান, ফিলিপাইনস আর ভিয়েতনামের সাথেও। চীন হুঁশিয়ারি দিয়েছে চীন সাগরে নির্মিত কৃত্রিম দ্বীপগুলোতে চীনকে যেতে বাধা দিলে তা ভয়ঙ্কর সঙ্ঘাতে রূপ নেবে, বড় আকারে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। অন্য দিকে, যুক্তরাষ্ট্র সতর্ক করে দেয়Ñ দক্ষিণ চীন সাগরের বিতর্কিত এলাকায় চীন যেসব কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করছে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত সেখানে তাদের যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেয়া।
দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সাথে জাপানের কোনো বিরোধ নেই; তবে পূর্ব চীন সাগরের সেনকাকু বা দিয়াওউ দ্বীপ এলাকার মালিকানা নিয়ে চীন ও এশিয়ার সবচেয়ে বৃহৎ নৌবহরের অধিকারী জাপানের বিরোধ দীর্ঘদিন ধরে চলছে। উভয় দেশই দ্বীপপুঞ্জটিকে নিজের বলে দাবি করছে। জাপান দ্বীপটির নাম দিয়েছে সেনকাকু। আর চীন নাম দিয়েছে দিয়াউ। এই বিরোধের জের ধরে দু’টি দেশ ওই দ্বীপপুঞ্জ এলাকায় পাল্টাপাল্টি জাহাজ ও বিমান পাঠিয়েছে। তাইওয়ানও এই দ্বীপপুঞ্জের দাবিদার এই দ্বীপপুঞ্জে হাজার হাজার মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে। পূর্ব চীন সাগরের কাছে আমেরিকা, ভারত ও জাপানের যৌথ সামরিক মহড়া ওই এলাকায় সংঘর্ষের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে; সমুদ্র ও আকাশসীমার পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তিন দেশের সামরিক মহড়া সমুদ্র উপকূলে চীনের সামরিক কর্মকাণ্ডের জন্য হুমকি; যার প্রধানতম লক্ষ্য হচ্ছে সামরিক দিক থেকে চীনকে কোণঠাসা করা। মহড়ায় সাবমেরিন শনাক্ত করার জাহাজও ব্যবহার করছে জাপান। অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ভারতসহ আরো কয়েকটি দেশ আমেরিকার মদদে এই অঞ্চলে চীনবিরোধী নৌ-কূটনীতি গড়ে তুলতে ব্যস্ত বলে অভিযোগ উঠেছে।
দক্ষিণ চীন সাগর ও পূর্ব চীন সাগরে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে চীনা রণতরী, চলছে মেরিন কর্পস বানানোর প্রক্রিয়াও। ২০২০ সালের মধ্যেই দ্বিতীয় বিমানবাহী রণতরী পেতে চলেছে চীনা বাহিনী। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রকে সামনে রেখে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় চীনা সামরিক বাহিনীকে ঢেলে সাজাচ্ছে বেইজিং।
দক্ষিণ চীন সাগরের বিরোধপূর্ণ অংশে চীন অনেক দিন ধরেই একগুচ্ছ কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করছে, কৃত্রিম দ্বীপগুলোতে সামরিক স্থাপনা তৈরি ও সরঞ্জামাদি মোতায়েন করেছে, ক্ষেপণাস্ত্রও মোতায়েন করেছে এবং এর ওপরের আকাশে উড্ডয়ন নিষিদ্ধ এলাকা প্রতিষ্ঠা করেছে। দক্ষিণ চীন সাগরের বিরোধপূর্ণ সমুদ্রসীমায় অস্ট্রেলিয়ার বড় ধরনের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। আর এই ঘাঁটি থেকেই আমেরিকার বিমান ও নৌবাহিনী এই অঞ্চলে তৎপরতা চালাচ্ছে।
দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের অধিকৃত স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জে নতুন অনেক অবকাঠামো তৈরি করেছে চীন। ছোট দ্বীপটিতে একটি শহরসহ অপারেটিং বেস তৈরি করা হচ্ছে। চীন দাবি করে আসছে, দ্বীপগুলো তাদের প্রতিরক্ষার জন্য প্রয়োজন এবং এসবের কাছে কোনো বিমান বা নৌকা এলেই প্রতিক্রিয়া দেখায়। স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জে রানওয়ে, হ্যাঙ্গার এমনকি সার্ফেস টু এয়ার মিসাইলও রয়েছে। এই সাগরে চীন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচলে নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় এবং পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তেলভর্তি ও মালবাহী জাহাজ চলাচলের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশী সামরিক শক্তির উপস্থিতি ঠেকাতে চায় এবং জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি পেতে চায়। ফলে চীন ছাড় দিতে রাজি বা প্রস্তুত নয়। এ অবস্থায় দক্ষিণ চীন সাগর শব্দটাই হয়ে উঠেছে যেন দ্বীপ মালিকানা বিরোধের প্রতীক।
সাম্প্রতিক চীন-যুক্তরাষ্ট্র স্নায়ুযুদ্ধের অন্যতম প্রভাবক হলো চীন সাগরের ভূ-কৌশলগত গুরুত্ব। দক্ষিণ চীন সাগর হলো পৃথিবীর অন্যতম জ্বালানি পরিবহনের কেন্দ্রবিন্দু। প্রায় ৭ বিলিয়ন ব্যারেল তেল এবং ৯০০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদ রয়েছে, যা এ অঞ্চলে ভবিষ্যৎ জ্বালানি সমস্যা উত্তরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পৃথিবীর প্রায় ৫০ শতাংশ সামুদ্রিক বাণিজ্য হয় মালাক্কা, সুন্দা ও লম্বক প্রণালী দিয়ে যা মূলত ধারণ করে দক্ষিণ চীন সাগর। ওয়াশিংটন এ অঞ্চলে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াসে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বন্ধু দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক আরো জোরদার করতে চায় এবং তাদের আস্থা অর্জন করতে চায় চীনকে মোকাবেলার জন্য। বেইজিং যদি অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে তাহলে চীন প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবকে পরিণত হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ক্ষমতার ভারসাম্যে আরো একধাপ এগিয়ে যাবে।