নাফতালি বেনেট। ইসরাইলের এই নেতা উগ্র ডানপন্থি হিসেবেই পরিচিত। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ধারণা প্রত্যাখ্যানকারী কট্টর এই নেতা হচ্ছেন নতুন প্রধানমন্ত্রী। আর অবসান ঘটাচ্ছেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর এক যুগের প্রধানমন্ত্রিত্বের।
ইংরেজি ভাষায় দক্ষ এবং গণমাধ্যমে সপ্রতিভ বেনেট প্রায়ই বিদেশি টেলিভিশন নেটওয়ার্কের আলোচনায় অংশ নেন এবং ইসরাইলের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের পক্ষে সাফাই গান।
ক্ষমতায় আরোহনের আগেই তার রাজনৈতিক জীবন যথেষ্ট আলোচিত ও বিতর্কিত। একের পর এক ফিলিস্তিনিদের বিষোদগার করে দেওয়া বক্তব্য দিয়েছেন তিনি। তার ক্ষমতা গ্রহণে ইসরায়েলের আগ্রাসী নীতির কোনো পরিবর্তন হবে কি? এমন প্রশ্ন ভাসছে সচেতন মানুষের মনে।
নাফতালি বেনেটের জন্ম ও বংশ পরিচয়
১৯৭২ সালে ইসরাইলের হাইফা শহরে জন্ম নাফতালি বেনেটের। যুক্তরাষ্ট্র বংশোদ্ভূত মা–বাবার ঘরে জন্ম তার। অভিবাসী হিসেবে বেড়ে উঠেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো শহরে। আধুনিক-অর্থোডক্স ইহুদি ধর্মের অনুসারী বেনেট। স্ত্রী ডেজার্ট শেফ গিলাটের সঙ্গে সংসারে রয়েছে চার সন্তান। রাজধানী তেলআবিবের উপশহর রা’নানায় বসবাস করেন তিনি। নেতানিয়াহুর মতো আমেরিকান ইংরেজিতে পটু বেনেট পড়েছেন জেরুজালেমের হেব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে।
বেনেটের কিংমেকার হয়ে উঠা
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন বেনেট। তবে এভাবে প্রধানমন্ত্রী হবেন, তা কল্পনাও করতে পারেননি। তার কট্টরপন্থি দল ইয়ামিনা গত সাধারণ নির্বাচনেও জিতেছে মাত্র ছয়টি আসনে। কিন্তু অল্প ওই আসনই এখন হয়ে উঠেছে তার তুরুপের তাস।
সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলে বেনেটের দলের আবস্থান যৌথভাবে পঞ্চম, কিন্তু তিনিই শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠেছেন ‘কিংমেকার’। কারণ সরকার গড়তে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রধান দুটি পক্ষের কাছে পর্যাপ্ত আসন নেই। তাই জোট গঠনে বেনেট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন।
ক্ষমতার উচ্চাভিলাষ থেকে ক্ষমতার মসনদে
প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হওয়ার উচ্চাভিলাষ বেনেটের যথেষ্টই পুরনো। ক্ষমতার মসনদে বসতে তিনি যে উচ্চাভিলাষী তা অনেকেই জানেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এবং ইসরাইলের পার্লামেন্টের বিরোধী দলীয় নেতা ইয়ায়ের লাপিদ-দুজনেই বেনেটকে প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণের প্রস্তাব দেন, সঙ্গে ছিল ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রস্তাব।
আদর্শগত বিস্তর মতপার্থক্য থাকার পরও শেষ পর্যন্ত লাপিদের সঙ্গে থাকতেই মনস্থ করেছেন বেনেট। শরিকদের সঙ্গে সমঝোতা অনুযায়ী লাপিদের জোটের প্রধন শরিক নাফতালি বেনেট প্রথমে দু’বছরের জন্য জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেবেন। এরপর পালাবদল হয়ে প্রধানমন্ত্রী হবেন লাপিদ।
নেতানিয়াহু-বেনেট সম্পর্ক
৪৯ বছর বয়সী নাফতালি বেনেটকে এক সময় নেতানিয়াহুর শিষ্য হিসেবেই বিবেচনা করা হত। তিনি ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বিরোধী দলে থাকা লিকুদ পার্টির নেতা নেতানিয়াহুর চিফ অব স্টাফের দায়িত্ব পালন করেছেন।
নেতানিয়াহুর সরকারে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছাড়াও অর্থ ও শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন নাফতালি বেনেট। কিন্তু এরপর দুজনের মতপার্থক্য দেখা দেয় এবং নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টি থেকে পদত্যাগ করে বেনেট যোগ দেন ধর্মীয় কট্টরপন্থি দল জিয়ুশ হোম পার্টিতে।
ইয়ামিনা দলের প্রধান নাফতালি বেনেট
২০১২ সালে উগ্র ডানপন্থী দল জিউস হোম পার্টির নেতৃত্বে আসেন নাফতালি বেনেট। ওই সময় পতনের মুখে থাকা এই দলকে চাঙা করেন তিনি। তার নেতৃত্বে পার্লামেন্টে দলটির আসনসংখ্যা বেড়ে চার গুণ হয়।
২০১৩ সালের নির্বাচনে জিয়ুশ হোম পার্টির সাফল্যে ভূমিকা রেখে নিজেও পার্লামেন্ট সদস্য হন তিনি। ২০১৮ সালে জিউস হোম পার্টির নাম বদলে ইয়েমিনা করেন তিনি। এই দল নিয়ে নেতানিয়াহুর জোট সরকারে যোগ দিয়েছিলেন বেনেট। তবে ওই বছরই এই জোট ভেঙে পড়ে।
২০১৯ সাল পর্যন্ত ইসরাইলের প্রতিটি জোট সরকারে মন্ত্রী হয়েছেন বেনেট। তবে ২০১৯ সালের নির্বাচনে তাদের ডানপন্থি জোট কোনো আসন জিততে ব্যর্থ হয়।
মাত্র ১১ মাসের ব্যবধানে সেই ব্যর্থতা কাটিয়ে ইয়ামিনা দলের প্রধান হিসেবে পার্লামেন্টে যোগ দেন তিনি। এখনো ইয়ামিনা পার্টির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
নাফতালি বেনেটের চিন্তাধারা
অতি কট্টরপন্থি হিসেবে চিহ্নিত বেনেট ইসরাইলকে একটি ইহুদি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করতেই বেশি উদ্যোগী।
তিনি বিশ্বাস করেন, জর্ডান নদীর পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম এবং সিরিয়ার গোলান মালভূমি- যা ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর থেকে ইসরাইল দখল করে রেখেছে- ঐতিহাসিক ও ধর্মীয়ভাবে ইসরাইলই ওই ভূখণ্ডের দাবিদার।
দীর্ঘদিন ধরেই তিনি ইসরাইলের অধিকৃত অঞ্চলে বসতিনির্মাণ কার্যক্রমে সমর্থন দিয়ে আসছেন, যদিও তিনি বলেছেন গাজার ওপর ইসরাইলের কোনো দাবি নেই।
ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বকারী গোষ্ঠী ইয়েশা কাউন্সিলের প্রধান হিসেবে ২০১০ সালে দায়িত্ব নেন বেনেট। এই কাউন্সিল অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে কাজ করে। বেনেট সবকিছু নতুন করে শুরুর কথা বলেছেন।
তবে ধর্মীয় অধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যদের তুলনায় তাকে বেশ উদার দেখা গেছে। আন্তধর্মীয় ও আন্তরাষ্ট্রীয় বিয়েতে তার আপত্তি নেই। এক্ষেত্রে ইয়ার লাপিদের সঙ্গে তার ব্যাপক মিল। নির্বাচন পরবর্তী ভাষণে তিনি ঐক্য ও সংশোধনের ডাক দিয়েছেন।
আইজ্যাক হারজোগ : ইসরাইলের নতুন প্রেসিডেন্ট
উগ্র জাতীয়তাবাদী বেনেট
পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনের কোনো অধিকার নেই ইহুদিদের- এ কথা বলায় এক ইসরাইলি আরবকে গালাগাল পর্যন্ত করেছিলেন তিনি। ইসরাইলের একটি টেলিভিশন বিতর্কে অংশ নিয়ে একবার এমন উগ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন বেনেট।
মধ্যপ্রাচ্য সংকটের দুই রাষ্ট্র সমাধান মানেন না ইয়ামিনা দলের প্রধান। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের ধারণাকে তিনি অতি কঠোর ভাষায় নাকচ করে থাকেন। ফিলিস্তিনি গেরিলাদের বিরুদ্ধেও অত্যন্ত কঠোর অবস্থান গ্রহণের পক্ষে নাফতালি বেনেট। তিনি গেরিলাদের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডকে সমর্থন করেন।
২০১৮ সালে সংঘাত বন্ধে গাজার নিয়ন্ত্রণকারী হামাসের সঙ্গে অস্ত্রবিরতি চুক্তিরও বিরোধিতা করেছিলে তিনি। বেনেট পুরোপুরি ইহুদি সংস্কৃতি মেনে চলেন এবং ইহুদিদের ধর্মীয় টুপি ‘কিপ্পা’ ব্যবহার করেন।
নাফতালি বেনেটের বিশেষ সুবিধা
সাবেক এই কমান্ডো নিজের চেষ্টায় হয়েছেন প্রযুক্তি খাতের সফল ব্যবসায়ী। রাজনীতিতে নামার আগে সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞতা এবং ব্যবসায়িক সমৃদ্ধি বিশেষ সুবিধা দিয়েছে বেনেটকে।
২০১৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি দিনে ১৭টা স্টেক খাই না, ব্যক্তিগত জেট বা ইয়টেও চড়ি না। সহজ কথায়, এটাই আমাকে নিজের মর্জিমাফিক চলার স্বাধীনতা দিয়েছে।’
নাফতালি বেনেট কতদিন ক্ষমতায় থাকবেন?
ডানপন্থি দল ইয়ামিনা পার্টির প্রধান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় থাকবেন আগামী ২০২৩ সালের ২৭শে আগস্ট পর্যন্ত। ইসরাইলের বিরোধী দলীয় ডানপন্থি নেতা নাফতালি প্রযুক্তি খাতের সফল ব্যবসায়ী। ইসরাইলের স্পেশাল ফোর্সের সাবেক কমান্ডো। ২০০৫ সালে ১৪৫ মিলিয়ন ডলারে টেক স্টার্ট–আপ বিক্রি করে রাজনীতিতে সক্রিয় হন বেনেট।
ইসরাইলি গুপ্তচর মুস্তারিবিন : টার্গেট কিলিংয়ের গোপন মিশন
নাফতালি বেনেট সম্পর্কে কী বলছেন নেতানিয়াহু?
ইসরাইলের বেনেটের নতুন সরকারকে বিপজ্জনক বলে আখ্যা দিয়েছেন লিকুদ পার্টির নেতা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। নেতানিয়াহুর মসনদ নড়বড়ে করে দেওয়া বেনেট নেতানিয়াহুর সরকারে প্রতিরক্ষা, শিক্ষা ও অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন; এখন তার কাছেই ক্ষমতা হারায়েছেন নেতানিয়াহু।
উগ্র জাতীয়তাবাদী দলের এই নেতা মধ্যপন্থীদের সঙ্গে জোট গড়তে রাজি হওয়ায় নড়বড়ে হয়ে গেছে, ইসরাইলকে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে নেতৃত্ব দিয়ে আসা নেতানিয়াহুর চেয়ার।
বেনেটের উত্থান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আগ্রহ
ডানপন্থী নেতানিয়াহুর দল ও সরকারে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে আসা বেনেটের এই উত্থান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আগ্রহের জন্ম দিয়েছে। একসময়ের প্রযুক্তি উদ্যোক্তা বেনেটের ইসরায়েলের রাজনীতিতে আবির্ভাব ডানপন্থী, উগ্র ধর্মীয় ও জাতীয়তাবাদী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে।
আক্রমণাত্মক বক্তব্যের জন্য পরিচিত বেনেটকে ঘিরে বিতর্ক কম হয়নি। অর্থনৈতিক নীতির দিক দিয়ে তিনি অতি উদারবাদী। ইরানের বিরুদ্ধে কট্টর অবস্থান রয়েছে তার।
সংস্কার চান বেনেট
গত বছর করোনাভাইরাস সংক্রমণ দেখা দিলে স্বাস্থ্যসেবা সংকটের দিকগুলো তুলে ধরে উচ্চকণ্ঠ হন নাফতালি বেনেট। করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি করোনার অভিঘাত মোকাবিলায় অর্থনৈতিক প্রণোদনা দেওয়ার প্রস্তাব করেন তিনি। করোনায় বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে সচল করা এবং শিক্ষা ও ব্যবসায়িক সংস্কার বাস্তবায়নে জোর দিতে চান নাফতালি বেনেট।
বিতর্কিত ও সমালোচিত বেনেট
২০১৩ সালে বেনেট বলেছিলেন, ফিলিস্তিনি ‘সন্ত্রাসীদের হত্যা করা উচিত, মুক্তি দেওয়া নয়’। বেশ কয়েকবার তাঁর এসব বিতর্কিত বক্তব্য আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
একবার তিনি বলেছিলেন, পশ্চিম তীর অধিকৃত নয়, কারণ এখানে কখনো ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্র ছিল না। তার আরেক বক্তব্য নিয়েও ঝড় উঠেছিল।
তিনি বলেছিলেন, ইসরাইল–ফিলিস্তিনিদের সংঘাতের কখনো অবসান হবে না। এটাকে মেনে নিতে হবে।
পূর্ণ নিরাপত্তা পাচ্ছেন বেনেট
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত পূর্ণ নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে বেনেটকে। ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা সিন বেতের পক্ষ থেকে এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা পাচ্ছেন।
সিন বেতের প্রহরার সক্ষমতা অনুযায়ী গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তা ও অ্যাটর্নি জেনারেলের মতামতের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার থেকে সিন বেতের ডিভিশনের নিরাপত্তার দায়িত্বের নিয়োজিত ব্যক্তিরা এমকে নাফতালি বেনেটকে নিরাপত্তা দেবেন।
সূত্র : আলজাজিরা, গার্ডিয়ান