বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ : বিশ্ব নিয়ন্ত্রণে চীনের মহাপরিকল্পনা

1200
বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ : বিশ্ব নিয়ন্ত্রণে চীনের মহাপরিকল্পনা

বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর আতংকের নাম চীন। তাদের শংকা বিশ্বের নেতৃত্ব চীনের হাতে চলে যাচ্ছে। তাই দেশটিকে রুখতে উঠে-পড়ে লেগেছে জি-৭ (G7) বা বর্তমান বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো। চীনকে ঠেকাতে মহামারি উপেক্ষা করে বৈঠকে বসেছেন জি-৭ নেতৃবৃন্দ। চীনের দ্য বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ -এর বিপরীতে আমেরিকাসহ অন্যান্য দেশগুলো নিয়েছে নতুন পরিকল্পনা।

তাই অনেকের মনেই প্রশ্ন, চীন তো তেমন কোনো অস্ত্র আবিষ্কার করেনি যার ভয়ে বড় রাষ্ট্রগুলো ভীত। তাহলে দেশটিকে কেন ভয় পাচ্ছে বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো? চীনকে ঠেকাতে কী পরিকল্পনা নিয়েছে G7-ভুক্ত দেশগুলো? কিভাবে চীন আসছে বিশ্ব নেতৃত্বে?

বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা BRI প্রজেক্ট কী?

বিশ্ব যখন অস্ত্রের প্রদর্শনী আর সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে ব্যস্ত, তখন বিশ্বে নেতৃত্ব দিতে চীন হাতে নিয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রজেক্ট; যার নাম- Chaina belt and road initiative, যার সংক্ষিপ্তরূপ BRI project.

BRI প্রজেক্ট হচ্ছে- চীনের একটি মেগাপ্রকল্প; যা বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতি করার পদ্ধতি। যেখানে নদীবন্দর, রাস্তা ও রেল লাইনের উন্নয়ন করে চীনের সাথে মিলিত হতে চলছে। যার মাধ্যমে পৃথিবী যুক্ত হবে দেশটির সাথে। যার নিয়ন্ত্রণ থাকবে চীনের হাতে। ফলে বিশ্বব্যাপী চীনের প্রভাব বাড়বে।

BRI প্রজেক্ট : কী আছে এই পরিকল্পনায়?

যদি আপনি চিন্তা করেন, BRI প্রজেক্ট শুধু যোগাযোগ বৃদ্ধি করবে তাহলে ভুল ভাবছেন। এর মাধ্যমে একই সাথে চীন নেতৃত্ব দিবে বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতিতে।

২০১৩ সালে চীন সর্বপ্রথম পৃথিবীব্যাপী এ চায়না বেল্ট ইনেশিয়েটিভ পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয়। পরিকল্পনায় বলা হয় যে, এটি তৈরি করা হবে ২০০০ বছর ধরে যে রাস্তাগুলো এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল তথা আধুনিক যানবাহন আবিষ্কার হওয়ার আগের ম্যাপ অনুসারে।

এ বিষয়ে গবেষক আলিস পোলিটি বলেন, এটি সত্যি অনেক বড় একটি প্রকল্প। যেখানে পৃথিবীর ৬০% মানুষকে অন্তর্ভুক্ত হতে বাধ্য করবে।
গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী যেহেতু এখানে ৬০% মানুষ যুক্ত হতে বাধ্য হবে। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, এর মাধ্যমে যোগাযোগ উন্নয়নের পাশাপাশি গড়ে উঠবে অনেকগুলো প্রজেক্ট।

THE BELT AND ROAD INITIATIVE -প্রজেক্টে স্থলপথে মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপকে একই রোডে অন্তর্ভুক্ত করবে। চীনের সাথে যারা যুক্ত হবে সেই দেশ সমৃদ্ধ হবে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, চায়না-পাকিস্তান অর্থনৈতিক জোনকে। পাকিস্তানে কয়লা ও গ্যাস বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং হাইওয়ে তৈরিতে ৬০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে যাচ্ছে চীন।

স্থল পথ ছাড়াও চীন তৈরি করছে জলপথ। এটি যুক্ত করবে দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ মহাদেশকে। এতে তৈরি করতে হচ্ছে সমুদ্রবন্দর, যার ওপরেও অনেক বড় অংক ব্যয় করতে যাচ্ছে দেশটি। এরই মধ্যে বন্দর তৈরি হয়েছে- শ্রীলঙ্কা, দুবাই, জিবুতি, গ্রিস ও স্পেনে। দূরত্বের মধ্যে পেরুতেও তৈরি হয়েছে বন্দর।

গবেষক জোনাস লেমারটিংক এ বিষয়ে বলেন, উদ্যোগটি একদমই ব্যাতিক্রমধর্মী। এ উদ্যোগের সাথে তৈরি হচ্ছে- বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প। এখনই বলা যাচ্ছে না এটি পৃথিবীকে কোথায় নিয়ে যাবে।

বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ : চীনের লাভ কী?

দ্য বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এখনও জানায়নি যে, এর মধ্যে কতটি প্রকল্প যুক্ত হবে। তবে তাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে প্রায় ২৬০০ প্রকল্প এবং যা বাস্তবায়িত হবে ১০০ দেশে।

এই প্রকল্পের ফলে চীনা পণ্যের প্রভাব আগের থেকে বৃদ্ধি পাবে বিদেশের মার্কেটে। অন্য দেশের সাথে যোগাযোগ তৈরির ফলে যেসব দেশ চায়নার সাথে থাকবে তাদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটবে।
বিদেশি লোনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে দেশগুলোতে। তৈরি হবে অনেক ইনভেস্টমেন্ট।

চীন বিষয়ক গবেষক আলিস পোলিটি বলেন, চীন এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে সময় নেবে ২০২৭ সাল পর্যন্ত। এটি বাস্তবায়নে ১.২ থেকে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হবে।
বোঝা-ই যাচ্ছে, এ প্রজেক্ট চীনের জন্য কতটা উপকারী এবং তাদের ব্যবসায় কেমন বৃদ্ধি পেতে চলছে!

রাজনীতি এবং অর্থনৈতিক গবেষক এইনার টারগান বলেন, চীন প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ কাচামাল আমদানি করে। এবং তারা বিক্রি করে বড় অংকের মূল্য লাভ করে থাকে। আমদানির জন্য অনেক রিসোর্সের দরকার হয় এবং বিক্রির জন্য দরকার হয় অনেক মার্কেট। পৃথিবীব্যাপী নিজেদের যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করা হলে তাদের পরিবহণ খরচ অনেক কমে যাবে। দ্যা বেল্ট অফ রোড ইনিশিয়েটিভ ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে চীনকে অনেক এগিয়ে দেবে। কিন্তু এর সাথে যুক্ত হবে পৃথিবীব্যাপী দেশটির রাজনৈতিক প্রভাব।

প্রকল্পে যুক্ত হলে দেশগুলোর লাভ কী?

এ রোডের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে চীন অনেক উন্নতি করবে। কিন্তু যে সব দেশ এ ব্যবসায়ের সুযোগ দিচ্ছে তাদের কিভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটবে? চীনের সিস্টেম সবসময় একটু ভিন্ন। বিশ্ব ব্যাংকের একটি গবেষণায় বলা হয়- এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৭০ লাখ গরিব মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে। এ পরিবহন প্রকল্প থেকে যে আয় হবে, তার থেকে প্রতিটি দেশ শেয়ার পাবে ৬.২%।
দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের উদাহরণ দিতে গেলে গরীব রাষ্ট্র জিবুতির উদাহরণ দেয়া যায়।
BRI প্রজেক্টের একটি সমুদ্রবন্দর তৈরি হয়েছে জিবুতিতে। বন্দরকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে ইথোপিয়ার রাজধানীর সাথে প্রসস্ত রেল লাইন। সাথে তৈরি হচ্ছে গ্যাস লাইন। যেখানে চীন ব্যয় করছে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার।

ইউরোপ-আমেরিকার বিকল্প উদ্যোগ B3W

চীনের দ্যা বেল্ট অফ রোড ইনিশিয়েটিভের সুযোগ-সুবিধা পেতে চায়নার ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে বিশ্বের অনেক দেশ। যেটাকে হুমকি মনে করছে বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো। নেতারা বুঝতে পেরেছেন- বিশ্ব রাজনীতি থেকে প্রভাব হারাচ্ছেন তারা।
বিষয়টিকে সামনে রেখে বিশ্বের ৭ ক্ষমতাধর দেশের সংগঠন জি-৭, কিছুদিন আগে বৈঠক করেছে। দেশগুলোর নেতৃবৃন্দ পরিকল্পনা করেছেন নতুন প্রজেক্ট চালু করার। যার নাম হবে B3W.
B3W -এর পূর্ণরূপ হচ্ছে- BUILD BACK BETTER WORLD. যেখানে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, চীনের প্রভাব ঠেকাতে দেশগুলোকে আরো বেশি সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।

B3W গুরুত্ব দিচ্ছে- সচ্ছতা, সুশাসন ও পরিবেশের দিকে। সাথে অন্তর্ভুক্ত করেছে প্রাইভেট সেক্টরগুলোকে সাহায্য করার ফান্ড।
তবে তারা এর জন্য কোনো বাজেট তৈরি করেননি এবং কোনো সময়ও নির্ধারণ করেননি।

এ বিষয়ে গবেষক আলিস পোলটি বলেন, তারা চেয়েছিলেন তাদের অর্থনৈতিক শক্তি ও উদ্যোগের দক্ষতা কেমন- তা দেখাতে। কিন্তু বর্তমানে তারা করোনা মহামারি নিয়ে মারাত্মক সমস্যায় রয়েছেন।

 সমাপনী কথা

The Belt of road initiative প্রকল্পের মাধ্যমে পৃথিবীব্যাপী চীনের যে প্রভাব তৈরি হচ্ছে, এটা দেখার জন্য শুধু সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু যেসব অঞ্চল চীনের পরিকল্পনার বাইরে রয়েছে, তাদের নিয়ে শক্তি ধরে রাখতে পারবে কি বর্তমান ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো?
চীনের মতো এত ঋণ ও উন্নয়নের সুযোগ সুবিধা কি দিতে পারবে তারা?