মনসুর আব্বাস : ইসলামপন্থী নেতা ইসরাইলি রাজনীতির কিংমেকার

মনসুর আব্বাস : ইসলামপন্থী নেতা ইসরাইলি রাজনীতির কিংমেকার

মনসুর আব্বাস একজন ইসরাইলি আরব রাজনীতিবিদ। ইসরাইলের রাজনীতিতে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আলোচিত নাম। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু–বিরোধী জোটে যোগ দিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছেন। ইসরাইলে বসবাসরত আরব-ফিলিস্তিনিদের রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড আরব লিস্টের (ইউএএল) নেতা।

ইসরাইলের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মনসুরকে নিয়ে সারাবিশ্বের মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। তাই আজকে জানাবো ফিলিস্তিনি হয়েও ইসরাইলি সরকার গঠনে অন্যতম নির্ধারক হিসেবে আত্মপ্রকাশকারী মনসুর আব্বাস সম্পর্কে।

মনসুর আব্বাস : জন্ম ও বংশ পরিচয়

ইসরাইলের রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সময়টিতে এখন রাজনীতির কেন্দ্রে থাকা মনসুর আব্বাসের জন্ম ১৯৭৪ সালের ২২ এপ্রিল ইসরাইলের উত্তরাঞ্চলীয় মাগহার জেলায়। ইসলামী বিশ্বাস নিয়েই তিনি একজন ইসরাইলি হিসেবে বাস করেন। তিনি ১৭ বছর বয়সে পিস মসজিদে খুতবা প্রদান শুরু করেছিলেন। মনসুর আব্বাসের তিন সন্তান রয়েছে। তিনি  মাগহারেই থাকেন।

মনসুর আব্বাসের শিক্ষাজীবন

মনসুর আব্বাস হিব্রু ইউনিভার্সিটি অব জেরুসালেম থেকে দন্তচিকিৎসা বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। পরে ইউনিভার্সিটি অব হাইফায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন। ছাত্রজীবন থেকেই মনসুর আব্বাস আরব ইসরাইলিদের মূলধারার রাজনীতিতে ও সমাজে অংশগ্রহণের পক্ষে কথা বলেন।

মনসুর আব্বাসের রাজনীতি

রক্ষণশীল মুসলিম মনসুর আব্বাস ছাত্রজীবনে আরব স্টুডেন্টস কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া সত্ত্বেও তিনি সান্নিধ্যে আসেন ইসলামিক মুভমেন্ট অব ইসরাইলের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ নিমার দারউইশের। এভাবেই রাজনীতিতে প্রবেশ করেন তিনি। মনসুর আব্বাস ২০০৭ সালে ইউএএলের সাধারণ সম্পাদক হন।

তিন বছরের মাথায় তিনি ইসলামিক মুভমেন্টের দক্ষিণাঞ্চলীয় শাখার ডেপুটি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালের এপ্রিলে নেসেটের নির্বাচনে আরব জাতীয়তাবাদী দল বালাদের সঙ্গে জোট বেঁধে লড়েন মনসুর। নির্বাচিত সদস্য হিসেবে নেসেট যান। তবে মতৈক্য না হওয়ায় এবারের নির্বাচনে এককভাবে লড়ে মনসুরের দল ইউএএল। ফলাফল চারটি আসনে বিজয়।

চারটি আসনে মনসুর আব্বাসের বিজয় তাকে কিংমেকার বানিয়েছে। তিনি ইসরাইলে আরব ভোটারদের বদলে দিতে চাচ্ছেন। তিনি বলছেন যে তার নিজস্ব লক্ষ্য আছে। তিনি নেতানিয়াহু বা অন্য কারো পকেটের লোক হবেন না। মনসুর আব্বাস একজন দক্ষ রাজনীতিক হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। তিনি অত্যন্ত সুসংগঠিতভাবে নির্বাচন পরিচালনা করেছেন। তিনি পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সত্যিকারের সাম্য নিয়ে সহাবস্থানের পক্ষে।


আইজ্যাক হারজোগ : ইসরাইলের নতুন প্রেসিডেন্ট


ইউনাইটেড আরব লিস্ট – ইউএএল

ইউনাইটেড আরব লিস্ট (ইউএএল) মূলত ইসরায়েলে বসবাসরত সংখ্যালঘু আরব-ফিলিস্তিনি মুসলিম নাগরিকদের রাজনৈতিক সংগঠন। হামাসের আদলে গড়া ইসলামপন্থী দলটির মূল অ্যাজেন্ডা আরব-ফিলিস্তিনিদের স্বার্থ সংরক্ষণ। আর ইউএএল -এর নেতা মনসুর আব্বাস।

ইসরাইলে সরকার গঠন প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়াকে ঐতিহাসিক অর্জন হিসেবে বিবেচনা করছে ইউএএল। কারণ ইসরাইল রাষ্ট্রে একটি ইসলামপন্থী দলের সত্যিকারের কিংমেকারের ভূমিকা সত্যিই অভাবনীয়। ইসলামী একটি দল চাইলে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর মতো প্রতাপশালী শাসককে ক্ষমতায় বসাতে পারেন আবার ইচ্ছে করলে ক্ষমতার বাইরেও ছুড়ে ফেলতে পারেন- এমন পরিস্থিতি কল্পনাকেও হার মানায়।

১৯৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই দলটি শুরু থেকে ইসরাইলের পার্লামেন্টে আসন পেয়ে আসছে। তবে কখনো সরকারের অংশীদার ছিল না। দেশটির বেশিরভাগই রাজনৈতিক দলই তাদেরকে সুনজরে দেখে না। ২০০৯ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলো দেশটির নির্বাচনী কর্তৃপক্ষ। পরে সুপ্রিম কোর্ট ওই নিষেধাজ্ঞা বাতিল করে দেয়।

২০২০ সালের নির্বাচনে ইসরাইলের আরব রাজনৈতিক দলগুলোর জোট- জয়েন্ট আরব লিস্টের অংশ ছিল তারা। এ জোট নজিরবিহীনভাবে তখন পনেরটি আসন পেয়ে সংসদেও তৃতীয় বৃহত্তম জোটে পরিণত হয়। তবে এবার একাই নির্বাচনে লড়ার জন্য গত জানুয়ারিতে ওই জোট ছেড়ে আসেন মনসুর আব্বাস। এ সিদ্ধান্ত দলটির ‘কিংমেকার’ হয়ে ওঠার পথ তৈরি করে দিয়েছে।

কী বলছে ইউএএল?

মনসুর আব্বাসের বিজয় ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংঘাতে দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। মনসুর আব্বাস বলেন, আরব ইসরাইলিদের অবস্থান বুঝতে হবে ইহুদিদের। তবে এর মানে কিন্তু এই নয় যে তিনি ফিলিস্তিনিদের কথা ভুলে গেছেন। তিনি বাস্তববাদী এবং কৌশলী। ফিলিস্তিনিদের জন্য তিনি কৌশলে লড়াই চালিয়ে যাবেন।

ইউএএলের সেক্রেটারি জেনারেল ইব্রাহিম হিজাজি বলেছেন, ‘আরব দলগুলো বরাবরই শাসনকাঠামোর প্রভাববলয়ের বাইরে রয়েছে। আমরা শাসনকাঠামোর অংশ হয়ে আবাসন, অপরাধ ও সহিংসতা দমনের মতো বিষয় নিয়ে সরাসরি কাজ করতে পারব। যা ইসরাইলের আগের বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে আরব-ফিলিস্তিনিদের সুবিধা দেবে।’

বাম থেকে, ইয়ার ল্যাপিড, নাফতালি বেনেট এবং মনসুর আব্বাস সরকার গঠন নিয়ে সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন। ছবি: এএফপি

কোণঠাসা দল যখন কিংমেকার

আরব রাজনৈতিক দলগুলো দেশটিতে আরবদের সমান অধিকারের পক্ষে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে এবং একই সাথে ফিলিস্তিনের প্রতিও তাদের দৃঢ় সমর্থন আছে। এটা একটা ঐতিহাসিক ঘটনা যে ইসরাইল রাষ্ট্রে একটি ইসলামপন্থী দল নির্ধারণ করবে কে হবেন পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। আরব দলগুলোকে সংসদে এবং রাজনীতিতে এতোদিন কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে।

বিরোধী জোটকে সমর্থন দেয়ার আগে মনসুর আব্বাস বলেছিলেন, ‘ইসরাইলে আরব জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন এবং তাদের বিরুদ্ধে অবিচার, বৈষম্য, তাদেরকে কোণঠাসা করে রাখার বিরুদ্ধে যে নেতা অবস্থান নেবেন তাকেই তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে সমর্থন দেবেন। সম্প্রদায়ের সমস্যা নিরসনে আমি দেশটির প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে আগ্রহী।

আমাদের চূড়ান্ত সীমা হলো আমাদের জাতীয় ও নাগরিক অধিকার। এ নিয়ে আমরা আপোস করব না। আমরা হয়তো সব দাবি আদায় করতে পারব না। তবে আমরা হাল ছাড়ব না। আরব সম্প্রদায়কে কোণঠাসা করাকে আমরা মেনে নেব না। আরবদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও অপরাধ বন্ধ করতে হবে। এসব করতে রাজি হলেই কেবল তার সমর্থন মিলবে।’

আলোচিত মনসুর আব্বাস

আদর্শগত পার্থক্য এড়িয়ে নেতানিয়াহু–বিরোধী জোট গড়তে চুক্তি করেছেন। তার হাত ধরে ইতিহাসে এবারই প্রথম কোনো ফিলিস্তিনপন্থী রাজনৈতিক দল ইসরাইলের সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ শরিকের ভূমিকা পালন করছে। ইসরাইলের সর্বশেষ পার্লামেন্ট নির্বাচনে তার দল চারটি আসন পেয়েছে।

ইসরাইলের সর্বশেষ পার্লামেন্ট নির্বাচনে তার দল চারটি আসন পেয়েছে

সমালোচিত মনসুর আব্বাস

ইসরাইল ও ফিলিস্তিন—দুই জায়গাতেই মনসুর আব্বাসের এমন রাজনৈতিক ভূমিকা তীব্রভাবে সমালোচিত হচ্ছে। সমালোচকেরা বলছেন, নেতানিয়াহুকে হটাতে আপাত সফল হলেও ফিলিস্তিনিদের স্বার্থ রক্ষায় মনসুরের বড় কোনো ভূমিকা পালন করতে পারবেন না। বরং এর মধ্য দিয়ে তিনি ফিলিস্তিনবিরোধী কট্টর ডানপন্থীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন।

আরব জাতীয়তাবাদী বালাদ পার্টির নেতা সামি আবু শেহাদে বলেন, মনসুর আব্বাস এমন একটি সরকারে যুক্ত হতে যাচ্ছেন, যেটা ইসরাইলের ভেতরে-বাইরে ফিলিস্তিনিদের স্বার্থের বিরুদ্ধে সদা সক্রিয়। এর মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে ফিলিস্তিনিদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছেন।

ইসরাইলের আরব দলগুলোর জোট জয়েন্ট লিস্টের সদস্য সামি আবু শেহাদ বলেন, কট্টর ডানপন্থীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মনসুর আব্বাস ঐতিহাসিক রাজনৈতিক অবস্থানে পরিবর্তন এনেছেন। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সক্রিয় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এটা বড় অপরাধ।

মনসুর আব্বাসকে নিয়ে আশা-নিরাশার দোলাচাল

ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আইনজীবী দিয়ানা ভুট্টু বলেন, ‘ইসরাইলের রাজনীতিতে কিংমেকার হবেন, এমন চিন্তা করে থাকলে বড় ভুল করছেন মনসুর আব্বাস। তিনি শুধু নতুন জোট গঠনে সহায়ক হবেন। তবে ফিলিস্তিনি হিসেবে এটা আমাদের কাজ নয়।

আমরা ওই শাসনকাঠামোর বিরোধীপক্ষ। আমাদের ভূমিকা হওয়া উচিত নিজেদের সম্প্রদায়কে রক্ষা করা। নেতানিয়াহু–বিরোধী জোট সরকার গড়তে পারলেও সেখান থেকে মনসুর ও তার দলের অর্জন হবে সামান্যই। ফিলিস্তিনের মানুষ মনসুরের নতুন জোটে যোগ দেওয়া সমর্থন করছে না।’

মনসুর আব্বাস চিন্তাধারা

নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে জোট গঠনের চুক্তি সইয়ের পরে সমর্থকদের উদ্দেশে দেওয়া এক বার্তায় ৪৭ বছর বয়সী মনসুর আব্বাস বলেছেন, ইসরাইলে রাজনৈতিক শক্তির ভারসাম্য আনতে আমরা নতুন জোটে নাম লেখাতে রাজি হয়েছি।

আমি এটা স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, আমাদের সমর্থন নিয়ে নতুন জোট সরকার গঠিত হলে, আমরা নীতিনির্ধারণে প্রভাব রাখতে পারব। এটা আরব জনগোষ্ঠীর জন্য লাভজনক হবে।


নাফতালি বেনেট : ইসরাইলের নতুন প্রধানমন্ত্রী


কী লাভ হবে ফিলিস্তিনিদের?

মনসুর আব্বাস বরাবর বলে এসেছেন, ইসরাইলে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের জীবনমান উন্নয়নে নেতানিয়াহুসহ ডানপন্থী রাজনীতিকদের সঙ্গে কাজ করতে তার আপত্তি নেই।

নতুন জোট সরকার গঠন করতে পারলে তিনি ফিলিস্তিনি–অধ্যুষিত ইসরাইলি শহরগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন ও অপরাধ দমনে আরও ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের বরাদ্দ পাবেন।

মনসুর আব্বাস নতুন সরকারের অধীন বসতি স্থাপনের নামে ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি বেআইনিভাবে দখল ও ধ্বংস করার ইসরাইলি পরিকল্পনা বন্ধে তৎপর থাকবেন।

কোনো পরিবর্তন আসবে কী?

ইসরাইলে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আইনি লড়াই চালান জাফর ফারাহ। স্থানীয় অধিকার সংগঠন মোসাওয়া সেন্টারের এই পরিচালক বলেন, ‘নতুন জোট থেকে মনসুর আব্বাস ইসরাইলি আরবদের জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ নিতে হয়তো সক্ষম হবেন।

তবে নেতানিয়াহু নিজেই এসব খাতে বরাদ্দের বিষয়ে রাজি ছিলেন। এটা নতুন কোনো অর্জন হবে না। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরাইলের দখলদারি ও কাঠামোগত আগ্রাসনের তুলনায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন খাতে বেশি মনোযোগ মনসুরের। এটা প্রমাণ করে, ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের দূরদর্শিতার অভাব রয়েছে।’

মনসুর আব্বাস, মানসুর আব্বাস নাকি মুনসুর আব্বাস

মনসুর আব্বাসের নাম লিখতে গিয়ে বাংলা সংবাদমাধ্যমগুলোতে তিনটি ধারা লক্ষ্য করা গেছে। কেউ লেখেন মনসুর আব্বাস। আবার কেউবা মানসুর কিংবা মুনসুর আব্বাস। ইংরেজিতে লেখা হয় Mansour Abbas.

কিন্তু আসলে কী হওয়া উচিৎ? মনসুর আব্বাস যেহেতু আরব, সেহেতু তার নাম আরবি উচ্চারণে মানসুর হওয়াটাই যৌক্তিক। তবে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ শব্দটিকে মনসুর উচ্চারণে অভ্যস্ত।

সেদিক বিবেচনা করে প্রচলিত তিনটি নামের মধ্যে মনসুর আব্বাস-কেই বেছে নিয়েছে জিনিউজ।

তথ্যসূত্র

Exit mobile version