সৌদি আরবের সাথে কি মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম ইসলামী আন্দোলন, মুসলিম ব্রাদারহুডের দূরত্ব কমছে? এই অঞ্চলের নানা ঘটনার কারণে মনে হচ্ছে, উভয় পক্ষ সৌদি শাসন এবং মুসলিম উম্মাহর সার্বিক কল্যাণের বিষয় অনুভব করে একে অন্যের সাথে সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলোকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে।
সৌদি টিভি নেটওয়ার্ক আল আরাবিয়ার সাথে এক দশকের বেশি সময়ের পর হামাসের বিদেশবিষয়ক পলিটিক্যাল ব্যুরোর প্রধান খালেদ মিশাল এক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এই সাক্ষাৎকার নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মধ্যে।
আমিরাতের প্রতি মোহভঙ্গ
আর এই সময়টাতে ইসরাইলের সাথে একাত্ম হয়ে মধ্যপ্রাচ্য নীতিকে পুনর্বিন্যাস করা সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে সৌদি আরবের প্রত্যক্ষ দ্ব›দ্ব-সঙ্ঘাত সৃষ্টির অবস্থা তৈরি হয়েছে। ইয়েমেনের যুদ্ধে কোনো স্বস্তিকর সমাধানের আগেই রিয়াদকে একা রেখে আবুধাবি নিজের সৈন্যদের ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। ইয়েমেনের মদদপুষ্ট স্থানীয় যোদ্ধাদের দিয়ে এডেন দখল করে সেখান থেকে সৌদি সমর্থিত হাদি সরকারকে বিদায় করে দিয়েছে তারা। ওপেক প্লাসের সভায় সরাসরি সৌদি আরবের সাথে সঙ্ঘাতে জড়িয়েছে আমিরাত।
এর পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে আমিরাতের ‘ইডিজেড’গুলো থেকে সৌদি আরবে শুল্ক রেয়াতে পণ্য প্রবেশের অধিকার বন্ধ করে দিয়েছে রিয়াদ। একই সাথে আবুধাবির অফিস থেকে সৌদি সরকারি কাজের জন্য দরপত্র প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
বরফ গলছে ব্রাদারহুড নিয়ে
এসব যখন ঘটছে, তখন সৌদি আরবে হামাস এবং ব্রাদারহুডের নেতাদের অনেককে মুক্তি দেয়া হচ্ছে। সৌদি আরবে এক সময় কোণঠাসা হয়ে পড়া ইসলামিস্টদের গুরুত্বপূর্ণ পদে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। তারা যুক্তরাজ্যে থাকা মুসলিম ব্রাদারহুডের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখছেন। মিসরীয় ব্রাদারহুডের প্রচার নেটওয়ার্ক এবং নির্বাসিত অনেক নেতার আবাসস্থল তুরস্ক থেকে যুক্তরাজ্যে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। সৌদি প্রশাসনে বাদশাহ সালমানের কর্তৃত্ব প্রত্যক্ষ রূপ গ্রহণ করছে।
রাজপরিবারের মধ্যে মুহাম্মদ বিন সালমানের উগ্রপন্থী নীতির কারণে যে বিভক্তি তৈরি হয়েছিল তিনি সেটিকে নিরাময়ের উদ্যোগ গ্রহণ করছেন বাদশাহ। একই সাথে সৌদি আরবের ধর্মীয় এস্টাবলিশমেন্টের গুরুত্ব ফিরিয়ে আনা এবং বিভিন্ন প্রভাবশালী গোত্রের সাথে সৌদ পরিবারের শাসকদের যে বিভক্তি তৈরি হচ্ছিল সেটাকে প্রশমিত করার চেষ্টা করছেন বাদশাহ নিজে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতায় থাকাকালে ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমানের সৌদি শাসনব্যবস্থার ওপর যে একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরি হয়েছিল তা অনেকখানি কমে গিয়েছে। সে সময় সৌদি সমাজকে ইসলামী রক্ষণশীলতা থেকে পশ্চিমা সেক্যুলারিস্ট সমাজে রূপান্তর করতে গিয়ে ওলামা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে গুরুত্বহীন করে তোলা হয়েছিল। ইসলামিস্টদের প্রশাসন থেকে বিদায় করা হয়। সৌদি রাজপরিবারের সিনিয়র সদস্যদের ক্ষমতা কাঠামো থেকে নিষ্ক্রিয় করে সেসব পরিবারের কনিষ্ঠ অথবা ক্ষমতাহীনদের দায়িত্বে নিয়ে এসে প্রশাসন সাজানো হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রে বাইডেনের ক্ষমতায় আসা, ইসরাইলের ক্ষমতা থেকে নেতানিয়াহুর বিদায় এবং বারবার অভ্যুত্থান বা বিদ্রোহ প্রচেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে বাদশাহ সালমান সৌদি সমাজ ও রাষ্ট্রিক ব্যবস্থাপনায় সৃষ্ট বিভক্তিকে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করছেন।
একচ্ছত্র ক্ষমতা থাকছে না এমবিএসের
এই প্রচেষ্টায় মুহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস ) সৌদি প্রশাসন নিয়ন্ত্রণে তার একচ্ছত্র ক্ষমতাই শুধু হারাননি তিনি ভবিষ্যৎ বাদশাহ হতে পারবেন কিনা তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এমবিএসের ব্যাপারে বাদশাহ সালমানের আস্থায় বড় ধরনের বিচ্যুতি ঘটে আরব আমিরাতের সাথে মিলে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠায় কোনো ছাড় ছাড়াই তার ইসরাইলকে স্বীকৃতিদানের প্রস্তাবে।
বিন সালমানের এ প্রস্তাব নাকচ করে দেন বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ। এরপর আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আর তার জামাতা কুশনারের চাপের মুখেও সালমান সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেননি। পরে সংযুক্ত আরব আমিরাত একতরফাভাবে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে দেশটির সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। সেই সাথে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দানে মুসলিম দেশগুলোকে সম্মত করার ব্যাপারে তেলআবিবের দূতের ভূমিকা পালন করে আবুধাবি।
সৌদি বাদশাহকে না জানিয়ে ইসরাইলের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন এবং ইসরাইলের মদদপুষ্ট হয়ে মুসলিম বিশ্বের নেতা হওয়ার জন্য আবুধাবির নানা ধরনের পদক্ষেপ সালমান বিন আবদুল আজিজ ভালোভাবে দেখেননি। এর মধ্যে জো বাইডেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ট্রাম্পের নীতি থেকে সরে আসার প্রবণতায় সৌদি আরবের জন্য নানাভাবে অরক্ষিত হওয়ার আভাস আসতে থাকে। ধর্মীয় এস্টাবলিশমেন্টের সাথে দূরত্ব, মুসলিম ব্রাদারহুডকে ক্রাশ করার প্রচেষ্টা চালিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম অরাষ্ট্রিক শক্তিকে শত্রু বানানো, রাজপরিবারের ভিন্নমতাবলম্বীদের অর্থসম্পদ কেড়ে নেয়া আর ইরান ও কাতার-তুরস্কের সাথে দূরত্ব ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকার মধ্যে সৌদি আরব ক্রমেই বড় রকমের ঝুঁকিতে পড়তে থাকে।
সালমানের পাঁচ উদ্যোগ
এই অবস্থায় বাদশাহ সালমান সুনির্দিষ্ট কিছু নীতি পদক্ষেপ নিয়ে অগ্রসর হওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রথমত, মুহাম্মদ বিন সালমান উদ্যোগী হয়ে ইয়েমেনে যে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে সেটির অবসান ঘটানো। এই প্রচেষ্টায় পাকিস্তান মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছে আর ইরানের সাথে প্রত্যক্ষ আলোচনায় মতের ব্যবধান ঘোচানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, সৌদি ধর্মীয় নেতৃত্বের পুরনো অবস্থান ও মর্যাদা ফিরিয়ে এনে, সৌদি জনমতে রাজতন্ত্রবিরোধী যে মনোভাব ক্রমেই চাঙ্গা হচ্ছে সেটাকে নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ গ্রহণ। তৃতীয়ত, সৌদি আরবের ভেতরে এবং পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে মুসলিম ব্রাদারহুড বিরোধী অবস্থান নিতে গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের জনমত এবং সমাজ কাঠামোতে সৌদি আরবের প্রভাব দুর্বল হয়ে পড়ে। সেটি পুনরুদ্ধার করতে মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে পুরনো সম্পর্ক ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হচ্ছে। এজন্য নির্বাসিত ব্রাদারহুড নেতৃত্বকে যুক্তরাজ্যে পুনর্বাসনে সহায়তা দেয়া এবং পর্যায়ক্রমে তাদের স্বদেশে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়াস নেয়া হয়েছে। চতুর্থত, ফিলিস্তিনি স্বার্থের বিপক্ষে অবস্থান নেয়ার ব্যাপারে যে নেতিবাচক ভাবমর্যাদা সৌদি আরবের সৃষ্টি হয়েছে সেটি পুনরুদ্ধারের জন্য ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগঠন হামাসের সাথে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করা। পঞ্চমত, রাজপরিবারের ভিন্ন মতের সদস্য ও কোণঠাসা পরিবারগুলোর আস্থা ফেরানোর ব্যাপারে উদ্যোগী হওয়া।
সালমান বাদশাহ ফয়সলের আমল থেকেই সৌদি রাজপরিবারের অভ্যন্তরীণ সংহতির বিষয়াদি দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত যুবরাজ ছিলেন। ফলে রাজপরিবারের সব খুঁটিনাটি বিষয় তার জানা রয়েছে। অন্য দিকে তিনি ছিলেন সৌদি আরবের ফিলিস্তিনের বিষয় দেখাশোনার দায়িত্বপ্রাপ্ত যুবরাজ। মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে সম্পর্ক ও যোগাযোগ বজায় রাখার দায়িত্বও তিনি এক সময় পালন করেছিলেন। ফলে ধারণা করা হচ্ছে বাদশাহ সালমান যেভাবে এখন দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে কার্যকরভাবে সক্রিয় হচ্ছেন তাতে তার পক্ষে সৌদি সমাজ ও রাষ্ট্র্রে এর মধ্যে যে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে, তা নিরসনে কার্যকর ভূমিকা পালন করা সম্ভব হবে।
তবে বাদশাহ সালমানের একটি বড় দুর্বলতা হলো তার পুত্র মুহাম্মদ বিন সালমানের ব্যাপারে। তিনি এই পুত্রের বেপরোয়া পদক্ষেপ গ্রহণের সামর্থ্যরে মধ্যে পিতা আবদুল আজিজের ছায়া প্রত্যক্ষ করতেন। কিন্তু পিতার সে আস্থা মুহাম্মদ বিন সালমানের ব্যাপারে রক্ষা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে বাদশাহ বড় একটি ধাক্কা খান তার অগোচরে ইস্তাম্বুলের সৌদি মিশনে বিখ্যাত সাংবাদিক জামাল খাশোগির নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়। এই ঘটনার প্রভাব এতটা গভীর হয় যে, সালমানের ব্যক্তিগত উদ্যোগ গ্রহণের পরও পুত্র মুহাম্মদকে ক্ষমতার উত্তরাধিকারের অবস্থানে ফেরানো সম্ভব হচ্ছে না। আমেরিকায় বাইডেন প্রশাসন দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বাদশাহ সালমানের সাথে সরাসরি সব যোগাযোগ রক্ষা করছেন। ট্রাম্পের সময় একাধিকবার যুক্তরাষ্ট্র সফরে যেতে পারলেও বাইডেনের সাথে এমবিএস সরাসরি সাক্ষাৎ পর্যন্ত করতে পারেননি। সর্বশেষ, খালিদ বিন সালমানকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছেন পিতা বাদশাহ সালমান। এই সফরে খাশোগি হত্যাকাণ্ডের বিচারের বিষয় এবং ক্রাউন প্রিন্সের উত্তরাধিকারের প্রশ্ন নিয়ে কথাবার্তা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
৬ মাসে অনেক পরিবর্তন
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ২০২১ সালের প্রথম ৬ মাসে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তনই ঘটে গেছে। মিসরের শাসক জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ আল সিসি অস্তিত্বের চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে গেছেন। মিসর ও সুদানের সাথে সমঝোতা ছাড়াই ইথিওপিয়া নীল নদে নির্মিত রেনেসাঁ বাঁধে দ্বিতীয় দফা পানি পুনর্ভরনের কাজ শুরু করেছে। মিসরের পক্ষ থেকে তিউনিসিয়া বিষয়টি জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করেছে। এই বাঁধে প্রধান বিনিয়োগকারী হলো ইসরাইল এবং তার নব্য মিত্র সংযুক্ত আরব আমিরাত। সৌদি আরব, তুরস্ক, এমনকি ইরান পর্যন্ত এই ইস্যুতে মিসরের পাশে থাকলেও মুসলিম শক্তিগুলোর মধ্যে ভিন্ন শিবিরে অবস্থান কেবলই আমিরাতের। আমিরাত শুধু ইথিওপিয়ায় নীল নদে বাঁধ দেয়ার জন্য ইন্ধন জুগিয়েছে তাই নয়, সেই সাথে দক্ষিণ সুদানের নীল নদের ওপরও বাঁধ দেয়ার একটি উদ্যোগে ইসরাইলের সাথে মিলেমিশে কাজ করছে। এই দেশটি মুহাম্মদ বিন জাইদের নেতৃত্বে নিজেকে ইসরাইলের পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রিত স্যাটেলাইট কান্ট্রিতে পরিণত করে নিজের প্রভাব বিস্তারের স্বপ্ন দেখছে। এই স্বপ্ন শুধু সৌদি আরবকে আঘাত করেছে, এমন নয়। এটি বিক্ষুব্ধ করেছে মিসরকেও। তুরস্ক ও কাতারের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ এবং ইরান ও সিরিয়ার সাথে মিসরের প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য যোগসূত্র রক্ষার মূল কারণ এটাই।
মিসরে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মুরসির বিরুদ্ধে জেনারেল সিসির অভ্যুত্থান ও গণহত্যার ঘটনা থেকে শুরু করে তার সমর্থকদের বিরুদ্ধে নির্মম দমনাভিযান চালানোর ন্যক্কারজনক নানা ঘটনার মধ্যে তার একটি কাজ মিসরীয়রা প্রশংসার সাথে দেখছেন। সেটি হলো গাজায় সাম্প্রতিক ইসরাইলি হামলার সময় পরোক্ষভাবে হলেও হামাসকে সমর্থন দেয়া। ফিলিস্তিনের হামাস ও ফাতাহর মধ্যে সমন্বয়ের একটি উদ্যোগও মিসর গ্রহণ করেছে। ইথিওপিয়ার রেনেসাঁ বাঁধ, দক্ষিণ সুদানের নীল বাঁধ এবং সুয়েজ ক্যানেলের বিকল্প ক্যানেল তৈরি করার ইসরাইল-আমিরাতি উদ্যোগ দীর্ঘ মেয়াদে মিসরের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করার শামিল বলে মনে করেন কায়রোর অনেক বিশ্লেষক। এই পরোয়ানাকে মেনে নেয়া নতুন কোনো ‘ফেরাউন’ দেশটির ক্ষমতায় বসলেও সম্ভব হবে বলে অনেকে মনে করেন না। ফলে মিসরে যেই ক্ষমতায় থাকুন না কেন ইসরাইলের সাথে ভেতরে ভেতরে বৈরিতামূলক সম্পর্ক কোনোভাবেই এড়ানোর অবস্থা এখন নেই।
হামাস সৌদি সম্পর্ক
হামাসের সাথে মিসরের সাম্প্রতিক সম্পর্কের ইতিবাচক উন্নয়ন এবং সৌদি আরবের একই ধরনের উদ্যোগের মধ্যে একটি যোগসূত্র থাকতে পারে বলে মনে হয়। সৌদি টিভি আল আরাবিয়ায় খালেদ মিশালের সাক্ষাৎকারের বক্তব্যগুলো গভীরভাবে দেখলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। এই সাক্ষাৎকারে হামাস নেতা মিশাল বলেছেন ‘আমরা ও মুসলিম ব্রাদারহুড মতাদর্শিকভাবে একই ছিলাম এবং আছি, তবে আমাদের এ আন্দোলন স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। হামাসের এই আন্দোলন একটি প্রতিরোধ ও মুক্তির আন্দোলন; এটি শুধু যুদ্ধ প্রতিরোধের কোনো প্রকল্প নয়।’
হামাসকে দেয়া যেকোনো দেশের সাহায্য গ্রহণের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে মিশাল এই সাক্ষাৎকারে বলেন, আগে হামাসের এই স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতি বিভিন্ন আরব দেশের সমর্থন ছিল। সমর্থনকারী দেশের মধ্যে ইরানও রয়েছে। তবে কোনো দেশ থেকে সাহায্য গ্রহণের বিনিময়ে আমাদের আন্দোলনের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণকে পরিত্যাগ করা হয় না।
ইরানের সমর্থন প্রসঙ্গে হামাসের রাজনৈতিক শাখার বিদেশী ব্যুরো প্রধান নিশ্চিত করেন যে, তেহরান অস্ত্র ও প্রযুক্তিগত উপায়ে হামাসের আন্দোলনকে সমর্থন করেছিল। অন্যদিকে, যে কোনো আরব দেশে, বিশেষত সৌদি আরবের বিরুদ্ধে যে কোনো আক্রমণের বিষয়টি তারা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি হামাসের আন্দোলনের সাথে অতীতের সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের জন্য সৌদি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। এ সময় তিনি ২০০৭ সালে মক্কা চুক্তিতে পৌঁছার ব্যাপারে সৌদি প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, হামাস নয়, বরং ইসরাইল ও অন্যরা মক্কা চুক্তি অকার্যকর করার চেষ্টা করেছিল। হামাসের আন্দোলনকে একটি জাতীয় ঐক্য সরকার প্রতিষ্ঠার দিকে নিয়ে যেতে এই মক্কা চুক্তি যেখানে প্রধান ভূমিকা রেখেছিল সেখানে আমরা কিভাবে এর বিরোধিতা করতে পারি?
জেরুসালেম ও গাজায় সাম্প্রতিক ঘটনাবলি প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ইসরাইলি পুলিশের আল-আকসা মসজিদে হামলা এবং জেরুসালেমে বসবাসকারীদের বাস্তুচ্যুত করার কারণে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ আন্দোলন হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়।
ইসরাইলের সাথে বন্দিবিনিময় প্রসঙ্গে এই সাক্ষাৎকারে মিশাল বলেন যে, বাস্তবে এখনো কোনো অগ্রগতি হয়নি। হামাসের কাছে ইসরাইলি কোনো জীবিত বন্দি আছে কি-না কিংবা সৈন্যের কোনো লাশ আছে কি-না তা প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। সিরিয়ার সাথে হামাসের সম্পর্ক প্রসঙ্গে নতুন কোনো উন্নয়নের বিষয়ও অস্বীকার করেছেন মিশাল।
আল আরাবিয়ার সাথে এই সাক্ষাৎকারে খালেদ মিশাল সৌদি আরবে আটক করা হামাস নেতা এবং এর পরিসম্পদ ছেড়ে দেয়ার জন্য সৌদি কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। আল মনিটরের এক প্রতিবেদন অনুসারে, এই অংশটুকু সৌদি টেলিভিশন সম্প্রচার করেনি। অবশ্য এর মধ্যে অনেক হামাস নেতাকে সৌদি কর্তৃপক্ষ মুক্তি দিয়েছে বলে জানা গেছে।
সৌদি আরবের সাথে হামাস ও মুসলিম ব্রাদারহুডের সম্পর্ক উন্নয়নের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তা বেশ খানিকটা এগিয়েছে। এ ধরনের সংবেদনশীল যেকোনো বিষয় অগ্রসর হতে সময়ের প্রয়োজন। তবে ইতিবাচক অনেক কিছুই এখন দৃশ্যমান হচ্ছে। আগামী সময়টা সম্ভবত ব্রাদারহুডের জন্য রাতের অমানিশা কেটে ‘সকাল’ হওয়ার সময়।
mrkmmb@gmail.com