ইসরাইলি ধ্বংসযজ্ঞের প্রতীক আল-শিফা

19
ইসরাইলি ধ্বংসযজ্ঞের প্রতীক আল-শিফা

গাজার চিকিৎসকদের এক সময়ের গর্ব, ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের প্রধান হাসপাতাল আল-শিফা ইসরাইল-হামাস যুদ্ধে ইসরাইলি ধ্বংসযজ্ঞের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
ইসরাইলের উপর হামাসের ৭ অক্টোবরের আক্রমণের পর যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত রোগীরা বছরের পর বছর ধরে গাজার হাসপাতালের ডাক্তার ও নার্সদের সেরা সেবাটাই পাচ্ছিলেন। কিন্তু এই বছরের শুরুতে, তাদের সমস্ত কার্যক্রম বন্ধ করতে হয়।
ইসরাইলের দুটি সামরিক অভিযানে আল-শিফা হাসপাতাল ধ্বংস হয়ে গেছে। ইসরাইলি বাহিনী হাসপাতালটিতে ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে প্রথম ও ২০২৪ সালের মার্চ মাসে দ্বিতীয়বার হামলা চালায়।
ইসরাইলি সেনারা আল-শিফার পরিচালক মোহাম্মদ আবু সালমিয়াকে সাত মাসেরও বেশি সময় ধরে আটকে রেখেছে। সে সময় তাকে ‘নির্যাতন’ করা হয় বলে দাবি করেন তিনি।
এরপর থেকে হাসপাতালে একটি জরুরি বিভাগ পুনরায় চালু করা হয়েছে। যদিও হাসপাতালটির কমপ্লেক্সের বাকি অংশ যুদ্ধের আগুনে পুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
হাসপাতালের চিকিৎসক আবু জাফর বলেন, জরুরি বিভাগটি পুনরায় চালু করার জন্য হাসপাতাল কর্মীদের ‘ডায়ালাইসিস মেশিনগুলোকে ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে টেনে বের করতে হয়েছে।’

ইসরাইলি ধ্বংসযজ্ঞের প্রতীক আল-শিফা
ইসরাইলি ধ্বংসযজ্ঞের প্রতীক আল-শিফা

গাজা থেকে বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, ১৫ নভেম্বর রাতে যখন ইসরাইলি ট্যাঙ্কগুলো হাসপাতালে হামলা চালায়, জাতিসংঘের মতে এ হাসপাতাল কমপ্লেক্সে তখন কমপক্ষে ২,৩০০ লোক ছিল।
এদের অনেকেই এটিকে গাজার মধ্যে একটি নিরাপদ স্থান ভেবে এখানে আশ্রয় নিয়েছিল।
ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলের হামলায় বাস্তুচ্যুতদের মধ্যে একজন সংবাদদাতা বলেছেন, বন্দুকযুদ্ধ ও বিস্ফোরণে রোগী, কর্মচারী এবং যুদ্ধ থেকে আশ্রয় নেওয়া অন্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।
১৯ মার্চ ইসরাইলি বাহিনী ট্যাঙ্ক ব্যবহার করে দ্বিতীয় হামলা শুরু করে। ১১ দিন ধরে সৈন্যরা হাসপাতাস প্রাঙ্গনে চিরুনি অভিযান চালায়।
অভিযান শেষে ইসরাইলের সামরিক বাহিনী ‘২০০ সন্ত্রাসীকে’ হত্যা ও বিপুল পরিমাণ অস্ত্র খুঁজে পাওয়ার দাবি করে।
গাজার সিভিল ডিফেন্স এজেন্সি জানায়, ওই হামলার পর অন্তত ৩০০ জনের লাশ পাওয়া গেছে। এজেন্সিটি ফিলিস্তিনি উপকূলীয় ছিটমহল জুড়ে উদ্ধার কাজ চালায়।
কমান্ড সেন্টার নাকি স্বাস্থ্য সুবিধা?
ইসরাইলের সামরিক বাহিনীর দাবি, হামাস ও অন্যান্য ফিলিস্তিনি জঙ্গিরা আল-শিফা হাসপাতালকে তাদের কমান্ড সেন্টার হিসাবে ব্যবহার করায় ইসরাইল হাসপাতালটির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছে।
এ দাবির পক্ষে ইসরাইল একটি প্রেস ইভেন্টের আয়োজন করে। ইভেন্টে সৈন্যদের সাইটের নীচে সুড়ঙ্গ খুঁজে পাওয়ার ভিডিও ফুটেজ প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করে। যদিও কিছু বিশেষজ্ঞ ফুটেজের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ আরও জানায়, ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের আক্রমণের সময় আটক ২৫১ জিম্মিদের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে হাসপাতালে রাখা হয়েছে। নভেম্বরে একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধবিরতি চলাকালে মুক্তিপ্রাপ্ত জিম্মিরা ওই সময়ে তাদেরকে হাসপাতাল বা এ ধরনের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আটকে রাখা হয়েছিল বলে অভিযোগ করেছে।
সামরিক বাহিনী আরও বলেছে যে, আল-শিফা হাসপাতালের কাছে অন্তত দুই জিম্মি- নোয়া মার্সিয়ানো ও ইহুদিত ওয়েইসের মৃতদেহ পাওয়া গেছে।
হামাস ক্রমাগতভাবে হাসপাতালগুলোকে কমান্ড সেন্টার হিসাবে ব্যবহার করার বিষয়টি অস্বীকার করেছে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো যুদ্ধ পরিচালনার জন্য ইসরায়েলের সমালোচনা করেছে। ইসরাইলি সরকারের পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করে এএফপির তথ্য অনুযায়ী, হামাসের হামলায় ইসরাইলি পক্ষের ১,২০৫ জনের মৃত্যু হয়েছে- যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক।
হামাস পরিচালিত অঞ্চলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক সামরিক অভিযানে গাজায় কমপক্ষে ৪১,৪৩১ জন নিহত হয়েছে- যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক।
জাতিসংঘ এই পরিসংখ্যানকে নির্ভরযোগ্য বলে মত দিয়েছে। গাজায় এখনও ৯৭ জনকে জিম্মি করে রাখা হয়েছে, যার মধ্যে ৩৩ জনকে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী মৃত বলে দাবি করেছে।
সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিদ ফিলিস্তিনি-আমেরিকান ইয়ারা আসি বলেন, ইসরাইল প্রতিষ্ঠার দুই বছর আগে ১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত আল-শিফা হাসপাতালটি গাজার বৃহত্তম স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। এটি কেবল একটি হাসপাতালই ছিল না, এটি ছিল ফিলিস্তিনিদের জীবনের আশা ও এ ভূমিতে তাদের বসবাস করার ইচ্ছার একটি প্রতিফলন।
ইয়ারা যুদ্ধ অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্যতা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ।
ঘাসান আবু-সিত্তাহ বলেন, আল-শিফা হাসপাতাল গাজার অন্যতম বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে। তিনি একজন ফিলিস্তিনি-ব্রিটিশ সার্জন যিনি যুদ্ধের প্রথম ৪৩ দিন আহতদের চিকিৎসা করেন।
তিনি আরো বলেন, ‘প্রতিটি যুদ্ধের পর, এই হাসপাতালটি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।’
আবু-সিত্তাহ গাজায় ২০০৮-৯, ২০১২, ২০১৪ ও ২০২১ সালে আগের চারটি যুদ্ধের কথা উল্লেখ করে বলেছেন।
তিনি বলেন, ‘আল-শিফার ধ্বংসের পর, মানুষ দেখল যে, গাজা উপত্যকার উত্তরে চিকিৎসার জন্য তাদের যাওয়ার কোন জায়গাই নেই।’
আল-শিফা ধ্বংসের পর ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা মূলত ধসে পড়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমান করেছে যে, গাজায় মাত্র কয়েকটি ক্লিনিক চালু রয়েছে। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে এখন আহতদের আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা দ্বারা পরিচালিত উন্মুক্ত হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হবে।
আবু-সিত্তাহ বলেছেন, আল-শিফা ‘স্বাস্থ্য পরিচর্যা ব্যবস্থার মূল প্রাণকেন্দ্র ছিল। ইসরাইলের অভিযানগুলো এটি ধ্বংস করে দিয়েছে দিয়েছে।’