১৯৫০ সাল থেকে লেবানন অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ ছিল। যখন লেবানন কে বলা হতো প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড। লেবাননের রাজধানী বৈরুত সবার কাছে মধ্যপ্রাচ্যের প্যারিস হিসেবে পরিচিত ছিল। যেখানে সবসময় পর্যটকে পরিপূর্ণ থাকত। কিন্তু বর্তমানে লেবাননের খারাপ কিছু সিদ্ধান্তের কারণে অর্থনীতিতে ধস নেমেছে। মানুষের জীবন সংগ্রামের মুখে পড়েছে। জিনিসপত্রের দাম এতই বেশি যে মানুষ, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে পারছে না। এমনি খাবার, জ্বালানি ও ওষুধ মানুষের ক্রয়-ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। দেশের অর্ধেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে।
লেবাননের এক নাগরিককে সমস্যা সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, দেখুন, বেশিরভাগ বৃদ্ধ মানুষের জন্য আমার হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে। আমি দেখি, আমার বাবার চেয়েও বৃদ্ধ মানুষ খাবারের জন্য ঘুরছে। অনেকে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েও চিকিৎসা নিতে পারছে না। যে কোনো সময় তাদের মৃত্যু হতে পারে। কিন্তু তাদের জন্যও কেউ এগিয়ে আসছে না।
লেবাননে অর্থনীতিতে কিভাবে ধস নামলো?
১৯৭৫ সালে লেবাননে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। বামপন্থী, শিয়া মুসলিম, সুন্নি মুসলিম এবং খৃস্টানদের মধ্যে সংগঠিত হওয়া সে যুদ্ধ ১৫ বছর ধরে চলতে থাকে। যেখানে প্রায় ১ লাখ বিশ হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। ১৯৯০ সালে লেবাননে গৃহযুদ্ধ শেষ হয়।
এরপর আবার লেবানন পুনরায় পর্যটন শিল্পের প্রসার শুরু করে। বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটন শিল্প পুনরায় ফিরিয়ে আনতে অনুদান নেয়া হয়। দেশটির আয়ের আরেকটি বড় উৎস হয় রেমিট্যান্স। লক্ষাধিক প্রবাসী লেবানন নাগরিক পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে তাদের দেশে টাকা পাঠাতে শুরু করেন।
কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে তথা আরব বিশ্বে সবসময় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা লেগেই আছে। ফলে গত এক দশক ধরে বিদেশি রেমিট্যান্সে বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে।
সরকারের ধারাবাহিকভাবে অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা অর্থনীতিকে টেনে আস্তে আস্তে নিচে নামিয়ে দিয়েছে। উপসাগরীয় সুন্নি দেশগুলো তাদের অর্থায়ন বন্ধ করে দেয় যখন লেবাননে শিয়া ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহর শক্তিশালী রূপ দৃশ্যমান হয়। অন্যদিকে সরকার দেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সংস্কার করতে ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৮ সালের দিকে বিদেশি সাহায্য ও অর্থায়ন স্থগিত হয়ে যায়।
২০১৯ সালে দেশটিতে গণবিক্ষোভ শুরু হয়। তরুণ প্রজন্ম এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়, কিন্তু মূলত এ বিক্ষোভ যে রাজনৈতিক অভিজাতরা পরিচালনা করেছে তারাও সংকট এড়াতে ব্যর্থ ছিল। এরপর বৈরুত বন্দরে ২০২০ সালের ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এর সাথে চলছে ভয়াবহ করোনা মহামারী। লেবাননের অর্থনৈতিকভাবে ধসের মধ্যে, করোনা ও বৈরুতের বিস্ফোরণ দেশের অর্থনীতির কফিনে শেষ পেরেকটি বসিয়ে দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের র্যাংকিংয়ে গত ১৮০০ অর্থনৈতিক ধসের মধ্যে লেবাননের অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা শীর্ষে রয়েছে।
লেবাননের বর্তমান অবস্থা
২০১৯ সালে লেবাননের পাউন্ডের দাম আগের থেকে ৯০% কমে গেছে। ডলারের দাম হঠাৎ অনেক বেড়ে যায়। যার কারণে যাদের অবস্থান মোটামুটি ভালো ছিল তারাও দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে যায়। জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে গেছে। মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলছে। খাবারও কিনতেও হচ্ছে অনেক দাম দিয়ে, খাবারের দাম বেড়ে প্রায় ৪০০ গুণ।
নাজহা ওম আলি নামে এক নাগরিক বলেন, আমার কাছে যদি টাকা থাকে আমি খেতে পারবো, যদি না থাকে না খেয়ে থাকতে হবে। যদি আপনি আমার ফ্রিজ খোলেন সবজি, গোস্ত বা মুরগি পাবেন না। সামান্য পানি এবং রুটি আছে।
ওষুধ ও চিকিৎসায় সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে। তা-ও ফুরিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ খাতেও রয়েছে বড় ধরনের ঘাটতি। বেশির ভাগ জায়গায় প্রাইভেট জেনারেটরের ওপর নির্ভর করে চলতো। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় তা-ও চলতে পরছে না। প্রতিদিন নিয়ম করে কিছু সময়ের জন্য বিদ্যুৎ দেওয়া হয়।
কেয়ার ইন্টারন্যাশনালের কান্ট্রি ডিরেক্টর বুজার হোক্সা বলেন, এখানে শত শত বিজনেস বন্ধ হয়ে গেছে। হাজার হাজার মানুষ চাকরি হারিয়েছে। বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি ব্যবসা এবং যারা মধ্যবিত্ত ছিল তারা সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে।
বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২১ সালে লেবাননের অর্থনীতি আরো ১০% সংকুচিত হবে। জিডিপি নেমে যাবে। প্রতিবেদনে এটিকে একটি বিপর্যয়কারি অর্থনৈতিক ধস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সাধারণত যুদ্ধের পরে এ ধরনের বিপর্যয় ঘটে।
লেবাননে কর্মরত জাতিসংঘ কর্মকর্তা নাজাত রুশদি বলেন, লেবাননে যে সংকট চলছে এর প্রভাব শুধু লেবাননের নাগরিকদের ওপরই নয়, লেবাননে অবস্থানরত সবার ওপরে পড়েছে। আপনারা জানেন, লেবানন বিশ্বের সর্বোচ্চ মাথাপিছু শরণার্থী গ্রহণ করেছে। যেখানে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় সিরিয়ান ১০ লাখ এবং ফিলিস্তিনের ২ লাখ ৭০ হাজারেরও বেশি শরণার্থী।
লেবাননকে সাহায্যের ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের
পোর্ট বৈরুত বিস্ফোরণের বার্ষিকীতে লেবাননে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা করেছেন ১০০ মিলিয়ন ডলার মানবিক সহায়তা দেয়ার।
তিনি আরও জানান, লেবাননে গত ২ বছরে মানবিক কাজে ৫৬০ মিলিয়ন ডলার যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য করেছে। তিনি লেবাননে সাহায্য করতে সব দেশের প্রতি আহবান জানান।
কিন্তু যখন বিদেশি সাহায্য আসে তখনই হুমকি হয়ে দাঁড়ায় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ। তাদের দুর্নীতির কারণে সাধারণ জনগণ তেমন কিছুই পায় না।
জো বাইডেন তার বক্তব্যে কঠোরভাবে হুশিয়ারি দিয়েছেন, যদি এ সাহায্যের অর্থে যেন কোনো দুর্নীতি না হয় এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের বাইরে যেন খরচ না হয়। এ ব্যাপারে লেবাননের নেতৃবৃন্দকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।