হামাস ফিলিস্তিনের ইসলামপন্থী সংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়। ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও গাজা থেকে ইসরায়েলি দখলদারির অবসানের দাবিতে ‘ইন্তিফাদা’ বা ফিলিস্তিনি গণজাগরণ শুরুর পর ১৯৮৭ সালে হামাস গঠিত হয়। সংগঠনটির সনদ অনুযায়ী তারা ইসরায়েলকে ধ্বংস করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। আর তাদের চাওয়া হলো, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হবে বর্তমান ইসরায়েল, গাজা ও পশ্চিম তীর নিয়ে গঠিত একক ইসলামি রাষ্ট্র।
এই নিবন্ধে আমরা জানবো, হামাস কী? হামাস কোন দেশের সংগঠন? হামাসের সামরিক শক্তি এবং সংগঠনটির কার্যক্রম ও ইতিহাস সম্পর্কে।
হামাস কী?
হামাস জানবাজ মুজাহিদের সংগ্রামী সংগঠন। হারাকাত আল-মুকাওয়ামা আল-ইসলামিয়া -এর সংক্ষিপ্ত রূপ। ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন। ফিলিস্তিনের একটি ইসলামি রাজনৈতিক দল। দলটি গাজা শহর নিয়ন্ত্রণ করে।
হামাসের সামরিক শাখা ইজ্ আদ-দীন আল-কাসসাম ব্রিগেড। প্রতিষ্ঠাকাল ১৪ ডিসেম্বর ১৯৮৭। ফিলিস্তিনের গাজায় হামাসের সদর দপ্তর।
হামাসের মতাদর্শ হচ্ছে- আশআরী-মাতুরিদী, ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদ, ইসলাম, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, জায়ানবাদ বিদ্বেষ ও গণতন্ত্র। হামাস পরিচালিত বহু জনহিতকর সংস্থা আছে, যা গাজায় মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে।
হামাসের নেতৃত্ব
হামাসের নেতৃত্ব সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী তথ্য পাওয়া যায়। যেহেতু ইসরাইলি বাহিনীর টার্গেটে থাকেন সংগঠনটির নেতারা; সম্ভবত এ কারণেই সমান্তরাল নেতৃত্ব তৈরি করে দলটি।
উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী হামাসের বর্তমান মুখপাত্র ফাওজি বারহুম। পলিটিকাল ব্যুরোর প্রধান ইসমাঈল হানিয়া, পলিটিকাল ব্যুরোর উপ-প্রধান মুসা আবু মারজুক ও খালেদ মিশাল।
কট্টর ইসরায়েলবিরোধী আধ্যাত্মিক নেতা শেখ আহমেদ ইয়াসিন হামাস প্রতিষ্ঠা করেন। সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন- আব্দেল আজিজ আল-রান্তিসি, মাহমুদ জাহার, মোহাম্মদ তাহ আব্দেল ফাত্তাহ দুখান, ইব্রাহিম ফারেস আল-ইয়াজুরি, ইসা আল-নাশশার ইব্রাহিম কুকা, মোহাম্মদ হাসান, শামা ও হাসান ইউসুফ।
২০০৪ সালের মার্চে গাজায় ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত হন আহমাদ ইয়াসিন। পরের মাসেই নিহত হন আজিজ আল-রান্তিসি। এরপর প্রধান হন খালেদ মিশাল। তাকেও হত্যার চেষ্টা করে ইসরাইল। তবে ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সামনে আসেন ইসমাঈল হানিয়া।
হামাসের উত্থানপর্ব
ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও গাজা থেকে ইসরায়েলি দখলদারির অবসানের দাবিতে ‘ইন্তিফাদা’ বা ফিলিস্তিনি গণজাগরণ শুরুর পর ১৯৮৭ সালে হামাস গঠিত হয়। সংগঠনটির সনদ অনুযায়ী তারা ইসরায়েলকে ধ্বংস করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। আর তাদের চাওয়া হলো, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হবে বর্তমান ইসরায়েল, গাজা ও পশ্চিম তীর নিয়ে গঠিত একক ইসলামি রাষ্ট্র।
পিএলও-র বিরোধী শক্তি হিসেবে দাঁড় করাতে শুরুর দিকে ইসরাইল সরকার হামাসকে অর্থ সহায়তা দিয়েছিল বলে অনেকক্ষেত্রে দাবি করা হয়৷ তবে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠায় কোনো ধরনের ভূমিকার কথা বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে সংশ্লিষ্টরা৷
ব্রাদারহুডের সাথে হামাসের সম্পর্ক
মিশরীয় মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি শাখা ছিল হামাস। প্রথম ইন্তিফাদা ছড়িয়ে পড়ার পরপরই এটি গাজা শাখা ইসরাইলের প্রতি দ্বন্দ্বহীন ছিল এবং প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ ছিল।
হামাস প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য
সহ-প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনের ১৯৮৭ সালে দেয়া বক্তব্য এবং ১৯৮৮ সালের হামাস সনদ নিশ্চিত করে যে, হামাস আধুনিক ইসরাইলসহ ফিলিস্তিনকে ইসরাইলি দখল থেকে মুক্ত করতে এবং বর্তমানে ইসরাইল, পশ্চিম তীর এবং গাজা স্ট্রিপ এলাকায় একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
হামাস প্রাথমিকভাবে দুটি উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হয়। প্রথমত, এর সামরিক শাখা ইজ্জেদিন আল-কাশেম ব্রিগেডসের মাধ্যমে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, ফিলিস্তিনে বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কর্মসূচি পরিচালনা করা।
ইসরাইলকে অস্বীকার
পিএলও-র মতো হামাস ইসরায়েলের অস্তিত্বের অধিকারে বিশ্বাস করে না৷ তাদের প্রতীকে রয়েছে জেরুসালেমের ‘ডোম অব দ্য রক’৷ ইসরায়েল, গাজা ও পশ্চিম তীরকে একক ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হিসেবে তারা বিবেচনা করে৷
শান্তি চুক্তি প্রত্যাখ্যান
১৯৯৩ সালে ইয়াসির আরাফাত অসলো চুক্তির অধীনে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করেন, যার মধ্য দিয়ে ১৯৮৭ সালে শুরু হওয়া প্রথম ইন্তিফাদার অবসান হয়৷ হামাস এই শান্তি প্রক্রিয়া প্রত্যাখ্যান করে ইসরায়েলে হামলা অব্যাহত রাখে৷
হামাস-ফাতাহ সম্পর্ক
২০০৪ সালে আরাফাতের মৃত্যুর পর হামাস ও ফাতাহ’র মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয় এবং সেটা চরম আকার ধারণ করে ২০০৬ এর নির্বাচনের পর। ঐ নির্বাচনে হামাস জয়ী হয় এবং এর প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আরব রাষ্ট্রসমূহ ফিলিস্তিনে সাহায্য বন্ধ করে দেয়।
এরপর ২০০৭ সালে হামাস ফাতাহ সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীকে পরাজিত করে গাজার দখল নিয়ে নেয়। সেই থেকে গাজা শাসন করছে হামাস।
নির্বাচনে জয়
২০০৬ সালের জানুয়ারিতে গাজার সাধারণ নির্বাচনে হামাস পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে৷ ফিলিস্তিনি পার্লামেন্ট নির্বাচনে অধিকাংশ আসন জেতার পর জুন ২০০৭ সাল থেকে হামাস ফিলিস্তিন অঞ্চলের গাজা ভূখণ্ড পরিচালিত করছে।
মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বে ফাতাহ-এর অধীনে রয়েছে পশ্চিম তীর আর গাজা এলাকার নিয়ন্ত্রণ হামাসের হাতে৷ ২০০৮-০৯, ২০১২ ও ২০১৪ সালে ইসরাইলি সেনার সঙ্গে হামাসের তুমুল লড়াই চলে৷
সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত
১৯৯৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হামাসকে সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত করে৷ ২০০৩ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নও তাদেরকে সন্ত্রাসী তালিকায় রাখে৷ হামাস এই বিষয়ে আদালতে চ্যালেঞ্জ করে৷ তবে আদালত তাদের আবেদন বাতিল করে৷
যুক্তরাজ্য কানাডা, জাপান, নিউজিল্যান্ড, ইসরাইল, অস্ট্রেলিয়াও হামাসকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে৷
কিন্তু ইরান, রাশিয়া, তুরস্ক, চীন হামাসকে সিরিয়া সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করেনি।
হামাসের সহযোগী
হামাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সহযোগী কাতার৷ দেশটির আমির শেখ হামাদ বিন খলিফা আল-থানি প্রথম রাষ্ট্রনেতা, যিনি ২০১২ সালে হামাস সরকারের সঙ্গে দেখা করেন৷ এখন পর্যন্ত দেশটি হামাসকে ১৮০ কোটি ডলার দিয়েছে৷ হামাসের প্রতি তুরস্কেরও সমর্থন রয়েছে৷ সংগঠনটির নেতা ইসমাইল হানিয়ের পক্ষে রাজনৈতিক অবস্থান রয়েছে রেচেপ তাইয়েপ-এর্দোয়ানের৷ এছাড়াও বিভিন্ন উদ্যোগ ও ফাউন্ডেশনের সহযোগিতাও পায় তারা৷
হামাসের রকেট উৎস
সবশেষ সংঘাতেও ইসরাইলের উদ্দেশ্যে প্রতিদিন শতাধিক রকেট ছুঁড়েছে হামাস৷ দীর্ঘদিন হামাস রকেটের জন্য ইরানের উপর নির্ভরশীল ছিল৷ সুদান ও মিশর হয়ে ইরান থেকে অস্ত্র আসতো৷ তবে বর্তমানে গাজাতেই হামাস রকেট বানাচ্ছে বলেও ধারণা করা হয়৷
কী চায় হামাস?
১৯৯৪ সাল থেকে হামাস প্রায়শই বলে আসছে যে ইসরাইল যদি ১৯৬৭ সালের সীমান্তে সরে যায়, ক্ষতিপূরণ প্রদান করে, অঞ্চলগুলিতে অবাধ নির্বাচনের অনুমতি দেয় এবং ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের ফিরে আসার অধিকার দেয় তবে তারা একটি যুদ্ধবিরতি গ্রহণ করবে।
হামাসের সামরিক শক্তি ও আল-কাসসাম ব্রিগেড
ইজ্ আদ-দীন আল-কাসসাম ব্রিগেড হলো ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসের সশস্ত্র শাখা। ইজ্ আদ-দীন আল-কাসসামের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছে । সংক্ষিপ্ত রূপ আল-কাসসাম। এর নেতৃবৃন্দ হচ্ছেন মোহাম্মাদ দেইফ ও মারওয়ান ইসসা। সদরদপ্তর গাজায় অবস্থিত।
দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় থেকে এটি ইসরাইলের আক্রমণের প্রধান লক্ষবস্তুতে পরিণত হয়েছে। এই সংগঠনটির শক্তি সামর্থ্য বহু রাষ্ট্রকে বিস্মিত করে দিয়েছে। ইজ্ আদ-দীন আল-কাসসামকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও মিসর নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ব্রিগেড নেতা মোহাম্মদ দেইফকেও নির্বাহী আদেশ ১৩২২৪ এর অধীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশেষভাবে মনোনীত গ্লোবাল টেররিস্ট হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করেছে।
আল-কাসসাম ব্রিগেডের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে- কুরআন এবং রাসূল (স) এর সুন্নাহ আর মুসলিম শাসক ও বিদ্বানদের নীতি অনুসরনে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করা এবং ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকারের পূনঃপ্রতিষ্ঠায় অবদান রাখা।
আল-কাসসামের উদ্দেশ্য হল ফিলিস্তিনের জনগনকে জয়নবাদী ইহুদীদের দখলদারিত্বের হাত থেকে মুক্ত করা এবং ফিলিস্তিনী জনগণের সেই অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যা জয়নবাদীরা হরণ করেছে। সেই সাথে আল-কাসসাম নিজেকে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রতীক মনে করে।
আল-কাসসাম ব্রিগেড হামাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদিও তারা হামাসের অঙ্গ সংগঠন তবুও তাদের স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার রয়েছে। হামাসের বক্তব্য অনুসারেঃ ‘ইজ্ আদ-দীন আল-কাসসাম ব্রিগেড একটা বিচ্ছিন্ন সশস্ত্র সংগঠন এবং এর নিজস্ব নেতা রয়েছে যারা হামাসের আদেশ গ্রহণ করে না এবং তথ্য ও অগ্রগতির কথাও হামাস নেতাদের জানানো হয় না।’
যোদ্ধাদের পরিচিতি এবং সংগঠনে এদের অবস্থান মৃত্যু পর্যন্ত গোপন থাকে। এমনকি যখন তারা ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তখন তারা কালো মুখোশ পরিধান করে আর তার উপর সবুজ বেল্ট দিয়ে বাধা থাকে। ইজ্ আদ-দীন আল-কাসসাম ব্রিগেড স্বাধীন অণুশাখা মডেলে কাজ করে যার কারণে অনেক সিনিয়র নেতারাও অন্য শাখার খবর জানে না।
এই শাখাগুলো নেতাদের মৃত্যুর পর নিজেরাই নেতা নির্বাচন করে। আল আকসা ইন্তিফাদার সময়ে বিমান হামলায় অনেক নেতা মারা যায়। এদের মধ্য রয়েছে সালাহ শাহাদী ও আদনান আল গুলের মত বড় নেতা। সংগঠনটির বর্তমান এবং দীর্ঘমেয়াদী নেতা মুহাম্মাদ দেইফ যিনি পাচবার গুপ্তহত্যা থেকে বেচে গেছেন বলে কথিত আছে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে জাতিসঙ্ঘ বেসামরিক লোকজনকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করাকে জেনেভা কননেনশনের নিয়মবহির্ভুত বলে মনে করে। এবং সাধারণ মানুষদের উপর নির্বিচার রকেট হামলা ও আত্মঘাতি বোমা হামলা আত্নর্যাতিক আইনের রীতিবিরুদ্ধ। কাসসাম অবশ্য বরাবরই এসব অভিযোগ আস্বীকার করে আসছে।
অসলো চুক্তির পরপরই হামাসকে সহযোগিতার জন্য সংগঠনটির সশস্ত্র রূপান্তর ঘটে। ২০০৩ ও ২০০৪ সালে আধিকৃত জালাবিয়া এলাকায় ব্রিগেডটি ব্যাপকভাবে ইসরাইলী হামলার স্বীকার হয়। বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতাও মারা যান। তারপরও সংগঠনটি ধীরে ধীরে শক্তিশালী হতে শুরু করে এবং পরবর্তি বছরগুলোতে আক্রমণ করার মতো সক্ষমতা অর্জন করে।
এরপর তারা দলে যোগ দেবার মত প্রচুর স্বেচ্ছাসেবীও পেয়ে যায়। একদল গোপনে কাসসামকে বিভিন্ন হাতে বানানো অস্ত্র যেমন আল বানা, বাতর, ইয়াসিন ইত্যাদি সরবরাহ করে। কাসসাম রকেট তাদের আর্টিলারি প্রযুক্তিতে সর্বশেষ সংযোজন।
২০০৫ সালের প্রথমদিকে কাসসাম ইসরাইলী সরকার এবং ফিলিস্তিনী অথরিটির শান্তি আলোচনার পক্ষে মতামত দেয়। এই সুযোগে কাসসাম নিজেকে আবার জোড়ালোভাবে সংগঠিত করে।২০০৫ সালের আগস্টে ইজরাইল গাজা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করলে কাসসাম গাজায় ব্যাপক র্যালি করে। এসমস্ত র্যালিতে তারা নিজেদের প্রচুর অস্ত্রের মজুদ আর সৈন্য-সামন্তের ব্যাপকতা প্রদর্শন করে।
এই ব্রিগেডের উল্লেখযোগ্য সদস্য হচ্ছেন- ইয়াহইয়া আয়াশ, আদনান আল হুল, সালাহ শাহাদী, ওয়ালি নাসার, আহমেদ জাবেরী, সালামা আহমাদ, ইমাদ আব্বাস, নিদাল ফাতহি রাব্বাহ ফারহাত, আবু ওবায়দাহ (মুখপাত্র), ইয়াসিন আল-আসতাল ও মারওয়ান ইসসা।
আল-কাসসাম ব্রিগেডের শক্তি
১ জানুয়ারি ১৯৯২ সালে তাদের প্রথম অপারেশনের ঘোষণা দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে ‘আল-কাসসাম ব্রিগেড’। এ ব্রিগেডের একটি অংশ দরনসশান নামে একজন ইসরায়েলি রাবাইকে (ইসরায়েলি ধর্মযাজক) হত্যা করে। এক ঘোষণার মাধ্যমে হামাস আল-কাসসাম ব্রিগেডকে তাদের মিলিটারি শাখা হিসেবে ঘোষণা করে। শুরুতে সীমিত সংখ্যক সৈন্য নিয়ে শুরু করা এ ব্রিগেড এখন গাজার একটা বড় অংশ জুড়ে আছে।
কেবল গাজাতেই তাদের সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। এটি একটি সত্যিকারের সেনাদল, যেটিতে সেনাদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে কোম্পানি, ব্যাটালিয়ন এবং ব্রিগেড। নর্দার্ন গাজা ব্রিগেড, গাজা ব্রিগেড, সেন্ট্রাল গাজা ব্রিগেড এবং সাউর্দার্ন গাজা ব্রিগেড নামে আল-কাসাসামের চারটি ব্রিগেড আছে; যার মূল সৈন্য সংখ্যা অন্তত ৫০-৬০ হাজার।
একটি পিস্তল নিয়ে শুরু হয় এ সামরিক শাখা, এরপর অস্ত্রাগারে যোগ হয় একটি রাইফেল এবং এরপরে নিজেদের তৈরি মেশিন গান। ধীরে ধীরে ‘হোয়াজ’ এর মতো বিস্ফোরক যন্ত্র, আত্মঘাতী হামলার জন্য বেল্ট এবং দূর থেকে হামলার জন্য বিস্ফোরক যন্ত্র যোগ হয়। ২০০১ সালের ২৬ অক্টোবর আল-কাসসাম ব্রিগেড স্থানীয়ভাবে তৈরি রকেট দিয়ে ইসরায়েলে হামলা চালায়। এ রকেটের নাম ছিল ‘কাসসাম-১’। ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্যবহার করা হয় ‘কাসসাম-২’। এর মধ্যে ২০১২ সালের এক যুদ্ধে তারা এম-৭৫ ব্যবহার করে। এ সময় যুদ্ধে তারা ইসরায়েলের হাইফা শহরকে লক্ষ্য করে আর-১৬৯ রকেট ব্যবহার করে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের সেনাবাহিনীর মতো আল-কাসসাম ব্রিগেডের ইঞ্জিনিয়ারিং, এরিয়াল, আর্টিলারি এবং আত্মঘাতী স্কোয়াড রয়েছে। ইসরায়েলের সামরিক আগ্রাসন মোকাবিলার জন্য আল কাসসাম বিভিন্ন প্রযুক্তিগত উন্নতি সাধন করেছে। আল-কাসসামের মিলিটারি শাখা ‘আল-বাত্তার’, ‘আল-ইয়াসিন’ নামের কামান বিধ্বংসী গোলা তৈরি করে, যেটি ইসরাইলের সবচেয়ে শক্তিশালী মেরকাভা কামান ধ্বংস করতে সক্ষম।
কে এই ইজ্ আদ-দীন আল-কাসসাম?
ব্রিটিশ অধিভুক্ত ফিলিস্তিনের ইজ্ আদ-দীন আল-কাসসাম একজন মুসলিম ধর্ম প্রচারক। ১৯৩০ সালে আল-কাসসাম ”ব্ল্যাক হ্যান্ড” নামে ব্রিটিশ এবং ইহুদী আধিপত্যবাদ বিরোধী একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এখনো দলমত নির্বিশেষে ফিলিস্তিনের সকল মুসলিম তাঁকে বীর হিসেবে স্মরণ করেন। এখনো ফিলিস্তিনি মুসলিমদের জিহাদে উজ্জীবিত করে চলেছেন এই বীর।
ইজ-আদ-দীন আল-কাসসাম ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথিকৃৎ। ১৮৮২ সালে বর্তমান সিরিয়ার লাজকিয়ে শহরের জাবালি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ফিলিস্তিনকে স্বাধীন একটি ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ শুরু করা ব্যক্তিদের মধ্যে প্রথম সারির একজন তিনি।
তাঁর আসল নাম ইজ-আদ-দীন বিন আব্দুল কাদির বিন মুস্তাফা বিন ইউসুফ বিন মুহাম্মাদ আল কাসসাম। তাঁর বাবা আবদুল কাদির ছিলেন উসমানীয় যুগে শরিয়া আদালতের একজন কর্মকর্তা এবং কাদেরিয়া তরিকার একজন স্থানীয় নেতা। তাঁর দাদা কাদেরিয়া তরিকার একজন প্রধান শাইখ ছিলেন। পারিবারিকভাবে আল কাসসাম কাদেরিয়া তরিকার সুফি হিসেবে গড়ে উঠেন।
আল-কাসসাম ১৪ বছর পর্যন্ত পারিবারিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। অতঃপর ১৯০২ সালে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উদ্দেশ্যে মিসরের কায়রোতে অবস্থিত বিখ্যাত আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন করেন এবং সেখানে ইখওয়ানুল মুসলিমীনে (মুসলিম ব্রাদারহুড) যোগদান করেন তিনি। আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে আল-কাসসাম সুফিবাদের সাথে জিহাদী চেতনায় উজ্জীবিত হন।
১৯০৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষে তিনি সিরিয়ায় নিজ গ্রামে ফিরে যান এবং একটি কাদেরিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। সেখানে তিনি কাদেরিয়া তরিকা এবং কুরআনের আইনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা শিক্ষা দিতেন। শিক্ষকতা ছাড়াও তিনি ইবরাহিম ইবনে আদহাম মসজিদের ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
ইসলামের পুনর্জাগরণ যে শুধু ইসলামের মৌলিক বিষয়ে ফিরে যাওয়ার মাধ্যমেই সম্ভব এবং এর বিপরীতে সবচেয়ে বড় শত্রু যে সাম্রাজ্যবাদ, তা জনগণের মাঝে তুলে ধরার চেষ্টা করেন তিনি। তাঁর বক্তব্যসমূহ সমগ্র সিরিয়াতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে।
তিনি শুধু উনার আদর্শের মৌখিক প্রচার করেই ক্ষান্ত হননি, বরং ১৯১১ সালে সাম্রাজ্যবাদী ইতালি উসমানিয়দের কাছ থেকে লিবিয়া দখল করলে সরাসরি ওসমানী সৈন্যদের সাথে এক হয়ে ময়দানে যুদ্ধ করেছেন। এছাড়াও তিনি সিরিয়ায় লিবিয়ার যোদ্ধাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন। সামরিক প্রশিক্ষণ আছে এমন স্বেচ্ছাসেবকদের সংগঠিত করে তিনি লিবিয়ায় প্রেরণ করেন।
১ম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে আল-কাসসাম উসমানীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ও সামরিক প্রশিক্ষণ নেন। উসমানি খিলাফতের পরাজয়ের পর ১৯১৮ সালে, যখন ফ্রান্স বাহিনী সিরিয়া হামলা করে, তখন ফ্রান্স বাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেন, তিনি তাঁর ঘর বিক্রি করে জিহাদের জন্যে অস্ত্র কিনেন। তিনি বলেন,‘এটা গুরুত্বপূর্ণ নয় যে আমরা বিজয়ী হবো, আমাদের কাছে সর্বপ্রথম গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এই উম্মতকে এবং আগামী প্রজন্মকে আমরা শিক্ষা দিয়ে যাবো’।
ফ্রান্স দামেস্ক দখল করে নিলে যুদ্ধের শেষ দিকে তিনি জাবলাহতে ফিরে আসেন ও জাবলাহ রক্ষার চেষ্টা করেন। কিন্তু উসমানীয় শাসক পরাজয় মেনে নেওয়ায়, তারা আল-কাসসাম রহ.-কে সহায়তা করতে পারেনি। তখন তিনি একটি নিজস্ব বাহিনী গঠন করেন। পরবর্তীতে সাম্রাজ্যবাদী ফ্রান্সের শাম দখলের বিরুদ্ধে সংগ্রামের লক্ষ্যে জনগণকে এক করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন তিনি।
এ সময় ফ্রান্স সরকার তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি ও মৃত্যুদণ্ড পরোয়ানা জারি করে। ১৯১৯ সালে ফরাসিরা উত্তর সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে প্রবেশ করে। এ সময় আল-কাসসামের বাহিনীর সাথে ফরাসীদের তীব্র যুদ্ধ হয়। বছরখানেক ধরে তিনি ফরাসিদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যান। কিন্তু পরাজিত হন।
সিরিয়াতে বিপর্যন্ত হওয়ার পর আল-কাসসাম প্রথমে লেবাননের বৈরুতে যান পরে সেখান থেকে ফিলিস্তিনের হাইফাতে যান। তিনি ফিলিস্তিনে বসবাস শুরু করেন করেন এবং একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা শুরু করেন। এসময় ফিলিস্তিন ব্রিটেনের অধীনে ছিল। তিনি পুনর্জাগরণে বিশ্বাসী ছিলেন এবং ফিলিস্তিনের স্থানীয় কিছু প্রথার বিরোধিতা করতেন।
এর মধ্যে রয়েছে ইসলাম বহির্ভূত মৃত্যুপরবর্তী প্রথা, সন্তানদের মঙ্গল বা অর্জনের জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে কারমাল পর্বতের নিকটে খিজিরের মাজারে মায়েদের জিয়ারত এবং ধর্মীয় স্থানে গোত্রীয় নৃত্য। এসব কুসংস্কারচ্ছন্ন প্রথা বাদ দিয়ে তাদের সঠিক ইসলামের চর্চায় উদ্বুদ্ধ করেন তিনি। তার আকর্ষণীয় বক্তব্যে মানুষ ভুল পথ পরিত্যাগ করে।
১৯২৮ থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আল-কাসসাম হাইফায় জামিয়া আল-শুব্বান আল-মুসলিমিন দলের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। উত্তর ফিলিস্তিনের দরিদ্র মুসলিমদের মধ্যে আল-কাসসাম দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। ১৯২৯ সালে সুপ্রিম মুসলিম কাউন্সিল কর্তৃক হাইফার শরিয়া আদালতে বিয়ে রেজিস্ট্রার হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। এই দায়িত্বের কারণে তাকে উত্তরাঞ্চলের গ্রামগুলোতে সফরে যেতে হত।
তিনি সেখানকার বাসিন্দাদের কৃষি সমবায় গড়তে উৎসাহিত করেন। তার সফরের সময় তিনি গ্রামবাসীদেরকে তার তেজস্বী বক্তব্যের মাধ্যমে ব্রিটিশ ও ইহুদিদের প্রতিরোধ করতে উৎসাহিত করতেন। জিহাদের প্রতি আত্মোৎসর্গের প্রতীক হিসেবে তিনি পুরুষদের দাড়ি রাখা ও সবসময় সঙ্গে কুরআন রাখার ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন।
১৯৩০ সাল থেকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আল-কাসসাম সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করেন। তিনি এর জন্য “আল-কাফ আল-আসওয়াদ (কালো হাত)” নামে ব্রিটিশ এবং ইহুদী আধিপত্যবাদ বিরোধী একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। এটি জায়নবাদ বিরোধী ও ব্রিটিশ বিরোধী সামরিক সংগঠন ছিল।
সেখানে তিনি আল ফাতাহ আন্দোলনের বুদ্ধিবৃত্তিক পথপ্রদর্শক আমিন আল হুসাইনির সাথে পরিচিত হন। তাঁদের চেতনার ফসল হিসেবে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা আন্দোলন বা পিএলও এবং তারই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে হামাস আন্দোলনের উদ্ভব ঘটে।
জায়নবাদী ইয়াহুদিরা যখন বৃটেনের ছত্র ছায়ার পূর্ণ ফিলিস্তিন দখল করে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্যে বিভিন্ন চক্রান্ত ও গুপ্তহত্যা শুরু করে, তখন সিরীয় এ আলেম তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদ শুরু করেন। আল-কাসসামের গেরিলা সংগ্রাম ফিলিস্তিনের মাটিতে ইসরাইল নামক একটি রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনাকারী ব্রিটিশদের পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে অবধারিতভাবে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সাথে তার সংঘর্ষ শুরু হয়।
১৯৩৫ সালের ৮ নভেম্বর, ব্রিটিশ কনস্টেবল মোশে রোসেনফেল্ডের লাশ আইন হারুদে খুজে পাওয়া যায়। আল-কাসসাম ও তাঁর অনুসারীদেরকে এর জন্য দায়ী বলে ধারণা করা হয়েছিল। এরপর তাকে গ্রেপ্তারের উদ্যোগ নেয়া হয়। ফলে আল-কাসসাম ও তাঁর ১২ জন অনুসারী আত্মগোপনের উদ্দেশ্যে হাইফা ত্যাগ করেন।
শাইখ জাইদের গ্রামে ইয়াবাদের নিকটে একটি গুহায় ব্রিটিশ পুলিশ আল-কাসসাম কে ঘিরে ফেলে। সম্পূর্ণ সশস্ত্র ও সুসজ্জিত ৫০০ জন ব্রিটিশ সৈন্য আল কাসসাম ও তাঁর সহযোগীদের স্থল ও আকাশ পথে একযোগে হামলা করে অবরোধ করা শুরু করে। ২০ নভেম্বর সেখানে সংঘটিত দীর্ঘ লড়াইয়ে আল-কাসসাম ও তার তিন অণুসারী শহীদ হন এবং বাকিরা বন্দী হন।
তথ্যসূত্র
- উইকিপিডিয়া
- পার্সটুডে
- বিবিসি
- রয়টার্স